হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে মেয়ের শেষ কথাগুলো কেবল কানে বাজছে মো. সোলায়মানের। বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল সাড়ে তিন বছরের মেয়েটি। মেয়ে ফাতেমা বাবাকে বারবার বলছিল, ‘আব্বু, বাড়ি চলে যাব। আমার ভয় লাগছে। এখানে থাকব না।’
ডেঙ্গু আক্রান্ত ফাতেমা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। গত রোববার বিকেল পর্যন্ত কথা বলেছে সে। রোববার সন্ধ্যা থেকে তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ওই রাতে তাকে চমেক হাসপাতালে শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। গত সোমবার সকালে ফাতেমা মারা যায়।
মো. সোলায়মান ও শাহনাজ আকতার দম্পতির একমাত্র মেয়ে ফাতেমা। তাঁদের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর একমাত্র সন্তান ফাতেমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন দুজন। ৬ সেপ্টেম্বর তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে আনা হয় পরদিন বৃহস্পতিবার।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে ফোনে কথা হয় সোলায়মানের সঙ্গে। ফোনের ওপারে কেবল তাঁর কান্নার শব্দ। কিছুক্ষণ পর কথা বলতে পারলেন। বললেন, ‘মেয়েকে ভালো চিকিৎসার জন্য বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। মেয়ে আমার কথা বলেছে। খাওয়াদাওয়া করেছে। ১০ তারিখ সন্ধ্যা থেকে কথা আর বলেনি। ওই দিন রাতে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। সোমবার সকালে মারা যায়। বাঁচাতে পারলাম না।’
সোলায়মান বাহরাইনপ্রবাসী। তিন মাস আগে তিনি দেশে আসেন। এর আগে আরেকবার যখন দেশে এসেছিলেন, তখন ফাতেমার বয়স ছিল দুই বছরেরও কম। তখন ভালো করে কথা বলতে পারত না। আব্বু ডাকত শুধু। এবার দেশে ফেরার পর মেয়ে অনর্গল বাবার সঙ্গে কথা বলে গেছে। হাসপাতালেও কথা বলেছে সে।
বারবার বাড়ি ফিরতে চেয়েছে মেয়ে—এ কথা মনে করে কাঁদছেন সোলায়মান। পাশ থেকে ফাতেমার মা শাহনাজ আকতারের কান্নার শব্দও শোনা যাচ্ছিল। মেয়ের খেলনা, জামাকাপড়ে ফাতেমাকে খুঁজে ফিরছিলেন তাঁরা। ফাতেমার কোনো ছবিও কাউকে দেখাতে রাজি নন এই মা–বাবা। তাঁদের চাওয়া, কেবল নিজেদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকুক ফাতেমা।
সোলায়মান বলেন, ‘আমার আদরের মেয়েটিকে ডেঙ্গু কেড়ে নিল। আমরা কীভাবে থাকব। আমার স্ত্রীকেও সামলাতে পারছি না। ঘরজুড়ে তার স্মৃতি। মেয়ে আমার কেবল বাড়ি ফিরতে চেয়েছে। বলেছে, তার ভয় লাগছে।’
অবশেষে ফাতেমাকে নিয়ে বাবা মা বাড়ি ফিরেছেন সোমবার বিকেলে। তারপর কবরস্থানে চিরঘুমে শুইয়ে দেওয়া হয় তাদের আদরের ধনকে।
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ২৩ জনই শিশু। চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ২২৩ জন। হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৩৩২ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২১ জন, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ২৫ জন ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশার্স ডিজিজেস হাসপাতালে (বিআইটিআইডি) ৪৩ জন ভর্তি রয়েছেন।