জীবিকা জোগাতে হয় শিশুকাল থেকেই

স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র শিশুসন্তানকে কাঠের দোকানে কাজে দিয়েছিলেন এক নারী। কিন্তু মো. সাফায়েত ইসলাম নামের সেই শিশুর কাজ ভালো লাগত না। ২০২০ সালের শুরুতে ১১ বছর বয়সে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বাড়ি ছেড়ে রাজধানীর সদরঘাটে আসে। এখন সে বরিশালগামী লঞ্চে শিশুদের জন্য প্যাকেটজাত কম দামি খাবার বিক্রি করে।

বাবার মৃত্যু ও মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর মো. রনি হাসানের পরিবারে জায়গা হয়নি। রনির ভাষায়, তার ছয়-সাত বছর বয়সে তাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর নাটোর থেকে ট্রেনে চেপে রাজধানীতে আসে সে। এখন সে কারওয়ান বাজারে ‘ফোর স্টার ট্রেডার্স’ নামের একটি দোকানের সামনে রাখা ভ্যানে রাত-দিন থাকে, আর প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে।

গুলশান-২ নম্বর চত্বরে বেলুন বিক্রি করে সুমাইয়া (৯)। শিশুটি জানাল, কাছাকাছি এলাকায় তার বাবা হায়দার আলীও বেলুন বিক্রি করেন। সন্ধ্যার পর বাবার সঙ্গে সে কমলাপুরের বাসায় ফেরে।

জরিপে অংশ নেওয়া পথশিশুদের ৩০ শতাংশ খোলা জায়গায় থাকে, ৩৬ শতাংশ কখনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়নি। ৯১ শতাংশ পথশিশু কাজ করে। দেশের আট বিভাগের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭ হাজার ২০০ পথশিশু জরিপে অংশ নেয়। এদের ৪৯ শতাংশ ঢাকায় থাকে।

দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষা ও সুরক্ষাবঞ্চিত এসব শিশু শৈশব থেকেই নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নেয়। তাদের নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

এসব শিশুকে শ্রম থেকে সরিয়ে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে আজ ১২ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘শিশু শিক্ষা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ করি’।

গত মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফ প্রকাশিত ‘পথশিশুদের ওপর জরিপ ২০২২’ শীর্ষক জরিপে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া পথশিশুদের ৩০ শতাংশ খোলা জায়গায় থাকে, ৩৬ শতাংশ কখনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়নি। ৯১ শতাংশ পথশিশু কাজ করে। দেশের আট বিভাগের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭ হাজার ২০০ পথশিশু জরিপে অংশ নেয়। এদের ৪৯ শতাংশ ঢাকায় থাকে।

সোয়ারীঘাটের শিশু সাফায়েত বলে, ঘাটের ‘লাঠি বাহিনীকে’ দিনে ৬০ টাকা চাঁদা দিলে খাবার বিক্রির সুযোগ দেয়।

অর্ধেকই সহিংসতার শিকার, সুরক্ষা অপ্রতুল

গত ২৯ মে মহাখালীতে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর থেকে ফেলা রড মাথায় ঢুকে সুমন নামের এক পথশিশুর মৃত্যু হয়। একই দিনচট্টগ্রামে বন্দর থানার ইসহাক ডিপো টোল প্লাজার কাছে একটি টিনের ঘর থেকে ১৩-১৪ বছর বয়সী চার পথশিশু কিশোরীকে উদ্ধার করে পুলিশ। আশ্রয় ও কাজ দেওয়ার কথা বলে তাদের যৌন নিপীড়নমূলক কাজে বাধ্য করা হচ্ছিল।

কারওয়ান বাজারে রনি বলছিল, দুই দিন আগে মধ্যরাতে তাকে নেশাগ্রস্ত কয়েক তরুণ ঘুম থেকে তুলে মারধর করে প্যান্টের পকেটে থাকা সারা দিনের আয়ের ২০০ টাকা নিয়ে গেছে।

সোয়ারীঘাটের শিশু সাফায়েত বলে, ঘাটের ‘লাঠি বাহিনীকে’ দিনে ৬০ টাকা চাঁদা দিলে খাবার বিক্রির সুযোগ দেয়।

বিবিএসের জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০ শতাংশ পথশিশু বলেছে, কাজ করতে গিয়ে তারা সহিংসতার শিকার হয়। পথচারীদের হাতে নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি, ৮৩ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, এক-তৃতীয়াংশের বেশি পথশিশু ধূমপান ও নেশায় আসক্ত।

ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষাবিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমা খাইরুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, মা–বাবার নজরদারির বাইরে থাকা এই শিশুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। মেয়েশিশুরা আরও বেশি ঝুঁকিতে। পথশিশুদের নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই, যথেষ্ট সমাজকর্মীও নেই।

এক দোকানি বলেন, মা–বাবার অভাবের কথা বলে এসব সন্তানকে দিয়ে যান। এদের কাজে রাখলে বেতনও কম দিতে হয়।

পুনর্বাসন কেন্দ্রে আগ্রহ কম

পথশিশুদের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছয়টি এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুটি কেন্দ্র রয়েছে। কারওয়ান বাজারে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত ‘পথশিশুদের পুনর্বাসন কেন্দ্র’ থেকে রনি পালিয়েছিল। পালানোর কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘ওইখান থাইকা বাইরতে দেয় না।’

৪ জুন কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায়, বড় একটি কক্ষে পথশিশুরা টেলিভিশন দেখছে। ৮০ জনের কেন্দ্রে ৪০ ছেলে পথশিশু থাকে।

কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আফরোজা আক্তার বলেন, এখানকার শিশুদের নিয়মকানুনের মধ্যে থাকতে হয়, স্কুলে যেতে হয়। তাই অনেক পথশিশু এখানে থাকতে চায় না।

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুসারে, জরিপে অংশ নেওয়া ৩ শতাংশের কম শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকে। ৭২ শতাংশ বলেছে, তারা সেখানে থাকতে চায় না। কারণ, কড়া নিয়মকানুন, ধূমপান ও বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ কম।

পরিবারও কাজে বাধ্য করে

অনেক শিশুর পরিবারও কাজে ঢুকতে বাধ্য করে। কারওয়ান বাজারে এক হোটেল থেকে বিভিন্ন অফিস-দোকানে খাবার সরবরাহ করে ৯-১০ বছর বয়সী দুই শিশু। তারা জানিয়েছে, পরিবারই তাদের কাজে পাঠিয়েছে। কাজে আসার আগে তারা গ্রামে স্কুলে পড়ত।

এক দোকানি বলেন, মা–বাবার অভাবের কথা বলে এসব সন্তানকে দিয়ে যান। এদের কাজে রাখলে বেতনও কম দিতে হয়।

সবশেষ বিবিএস জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুসারে, প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার শিশুশ্রমে যুক্ত। ২০২৫ সালের মধ্যে সরকার শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য ঠিক করেছে।

সিএসপিবি প্রকল্প ফেজ-২ কার্যক্রমের ফোকাল পয়েন্ট সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. এমরান খান বলেন, তাঁদের কেন্দ্রগুলোতে শিশুদের আবদ্ধ না রেখে প্রয়োজনমতো আসা–যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। পারিবারিক কোনো কারণে শিশুদের বাসা থেকে বের করে দেওয়া বা শ্রমে যুক্ত না করতে সমাজকর্মীরা সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করেন। সারা দেশে আরও ২৫টি হাব প্রতিষ্ঠা ও সমাজকর্মীর সংখ্যা ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ করা হবে।

দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন

ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, পথশিশুদের অপরিচ্ছন্ন, রোগজীবাণুর বাহক, অপরাধী জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার আওতায় তাদের শৈশব নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের আবদ্ধ জায়গায় আনার আগে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের সেবা দিয়ে পথ থেকে সরে আসার আগ্রহ তৈরি করতে হবে। তাদের ঘিরে উদ্যোগগুলো শুধু প্রকল্পভিত্তিক না করে স্থায়ী রূপ দিতে হবে।