দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। মৃত্যুও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি যেমন, তাতে ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার লক্ষ্মণ স্পষ্ট। কিন্তু এডিস মশাবাহী এ রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দাতা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাগিদ দেওয়া হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাড়া কম।
ডেঙ্গু নিয়ে এবার ভয় দুটো কারণে। প্রথমত, এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ যেমন গত বছরের চেয়ে অনেক কম, মৃত্যুও কম। কিন্তু এবার মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত গত বছরের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি।
দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গু সাধারণত বর্ষার অসুখ। কিন্তু বাংলাদেশে অন্তত ২০২২ সালের অভিজ্ঞতা হলো ওই বছর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল অক্টোবর মাসে। এবার এখন পর্যন্ত সংক্রমণ ও মৃত্যু কম হলেও আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি, বিশেষ করে বর্ষা–পরবর্তী প্রবল বৃষ্টি ডেঙ্গুর অশনিসংকেত দিচ্ছে, এমন মত দেন জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
চার সপ্তাহ ধরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ১ আগস্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫১৭ জন। সপ্তাহ বাদে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৫৬৩ জনে। এর পরের সপ্তাহে সংক্রমণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯৮০ জনে। পরের দুই সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় যথাক্রমে ১ হাজার ৭৬ এবং ২ হাজার ১৮৫ জনে।
আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৬ হাজার ৯৯৯ জন, মৃত্যু হয় ৩০ জনের। আর জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬৯৯। ওই মাসে মৃত্যু হয় ১২ জনের।
চার সপ্তাহ ধরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ১ আগস্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫১৭ জন। সপ্তাহ বাদে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৫৬৩ জনে। এর পরের সপ্তাহে সংক্রমণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯৮০ জনে। পরের দুই সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় যথাক্রমে ১ হাজার ৭৬ এবং ২ হাজার ১৮৫ জনে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৩২০ জন। আর শুধু আগস্ট মাসেই এ সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার হয়ে যায়। আগস্টের মতো মৃত্যু আগের কোনো মাসে হয়নি।
২০২২ সালের স্মৃতি আমাদের আছে। তাই বর্ষা–পরবর্তী সময়ে এবারও ডেঙ্গুর শঙ্কা আছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।মোহাম্মদ শফিউল আলম, বিজ্ঞানী, সংক্রামক রোগ বিভাগ, আইসিডিডিআরবি
দেশে ডেঙ্গুর বড় আকারে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ২০০০ সালে। আর গত বছর (২০২৩) দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই মূলত ডেঙ্গুতে সংক্রমণ এতটা বেড়ে যায় যে তা ছিল আগের ২৩ বছরের বেশি। আগের সমস্ত বছরে যত মৃত্যু হয়নি, গত বছর তা ছাড়িয়ে যায়।
গত বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। এ হার বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে বেশি। এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম হলেও মৃত্যুহার বেশি, এবার তা শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ।
যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির মশাবাহিত রোগের গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সাল থেকে গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর চার ধরনের মধ্যে ডেন–৩ ছিল প্রাধান্যশীল। গত বছরের জুন মাসের পর থেকে ডেন–২ ব্যাপক হারে ছড়াতে থাকে। এখন যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ডেন–৩ তে আগে আক্রান্ত ছিলেন। তাই তাঁরা আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যুহারও বাড়ছে।
১৫টি ওয়ার্ডের ডেঙ্গুর সরঞ্জাম কমবেশি নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড। ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের মশা নিধনের সব ওষুধ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে আর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ওষুধ নষ্ট হয়নি, তবে সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গেছে সব।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. ইমদাদুল হক
আগস্ট মাসে গণ–আন্দোলনের সময় সহিংসতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৫টি ওয়ার্ডের ডেঙ্গু মশা ছিটানোর যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত বা চুরি হয় বলে ওই সিটির সূত্র জানায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্র বলে, যেসব যন্ত্র চুরি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর জন্য নিঃসন্দেহে ডেঙ্গু প্রতিরোধের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. ইমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ১৫টি ওয়ার্ডের ডেঙ্গুর সরঞ্জাম কমবেশি নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড। ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের মশা নিধনের সব ওষুধ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে আর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ওষুধ নষ্ট হয়নি, তবে সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গেছে সব।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এখন ডেঙ্গুর চিকিৎসার দিকে অপেক্ষাকৃত নজর বেশি। আবার সেটাও পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু ডেঙ্গু শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়। এখানে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতাসহ জনস্বাস্থ্যের জটিল বিষয় জড়িত। সেই প্রশ্নগুলো ঊহ্য থাকছে বা দৃষ্টিই দেওয়া হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে ডা. রোবেদ আমিনকে নিয়োগ দেয়। কিন্তু তিনি ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্তও যোগ দিতে পারেননি চিকিৎসকদের একটি অংশের বিরোধিতায়।
ডেঙ্গু বিষয়টিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো দিকনির্দেশনা বা উদ্যোগ নেই, এমনটাই বললেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একপ্রকার ‘ননফাংশনাল’ (অকার্যকর) প্রায় এক মাস ধরে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাদের কোনো সাড়া লক্ষ করা যাচ্ছে না। এদিকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে দিয়ে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে জোরদার প্রচেষ্টায় বিঘ্ন ঘটেছে।
বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এখন ডেঙ্গুর চিকিৎসার দিকে অপেক্ষাকৃত নজর বেশি। আবার সেটাও পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু ডেঙ্গু শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়। এখানে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতাসহ জনস্বাস্থ্যের জটিল বিষয় জড়িত। সেই প্রশ্নগুলো ঊহ্য থাকছে বা দৃষ্টিই দেওয়া হচ্ছে না।ডা. মুশতাক হোসেন, জনস্বাস্থ্যবিদ
গত আগস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৬ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। ওই দপ্তরের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, গত প্রায় এক দশকে বর্ষা–পরবর্তী সময়ে বৃষ্টি বেড়ে গেছে। আর এর প্রভাব পড়ছে ডেঙ্গুর বিস্তারে।
ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে পানিতে থাকা এডিস মশার কামড়ে। বর্ষা–পরবর্তী সময়ে বৃষ্টি হওয়ার ফলে ২০২২ সালে অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর সবচেয়ে বেশি বিস্তার হয়। ওই মাসে আক্রান্ত হন ২১ হাজার ৯৩২ জন। আর ওই বছর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় নভেম্বর মাসে—১১৩ জন। ওই বছর ‘অকালে’ ডেঙ্গুর বিস্তার পরের বছর অস্বাভাবিক বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস, চলতি সেপ্টেম্বর মাসেও বৃষ্টি বাড়তে পারে। এই বৃষ্টি এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের অভাব এ বছরও ডেঙ্গু বাড়তে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২২ সালের স্মৃতি আমাদের আছে। তাই বর্ষা–পরবর্তী সময়ে এবারও ডেঙ্গুর শঙ্কা আছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’