প্রথম আলো ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: আগামীর ভাবনা’ শিরোনামে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। সিপিডি পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি ইউনিট এই আয়োজনে সহযোগিতা করে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মডেল পরিবর্তিত হয়েছে। এটা আর মুক্তবাজার অর্থনীতি নেই। প্রতিযোগিতা ও অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি নেই। সরকার সেখান থেকে সরে এসে একটা ‘দলীয় অর্থনৈতিক মডেল’ তৈরি করেছে। পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির মাধ্যমে কিছু মানুষকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। যেখানে অংশগ্রহণমূলক প্রতিযোগিতা থাকে না, সেখানে জনস্বার্থে মূল্য নির্ধারিত হয় না। শুধু যে তাদের পছন্দের মানুষকে দিয়েছে তা না, আইন পাস করে এ বিষয়ে প্রশ্ন করার পথও বন্ধ করে দিয়েছে। এ বিষয়ে কেউ কোনো মামলা করতে পারবে না, প্রশ্ন করতে পারবে না। আইন করে দুর্নীতি ও লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা আছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এর দ্বিগুণ উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বছরের পর বছর তারা অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। এদের একদিকে অস্বচ্ছভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও স্থায়ী খরচ বাবদ তাদের অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য অনুগত কিছু মানুষকে বড়লোক হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু এই অর্থ দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকেই।
বলা হয় যে বিএনপির সময় যথেষ্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি। উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি থাকলেও বিদ্যুৎ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল। মানুষকে তখন চার–পাঁচ গুণ বেশি দাম দিতে হয়নি। কলকারখানাকে কর ছাড়া জেনারেটর আনতে দিয়েছি। সাধারণ মানুষের কিছুটা সমস্যা হলেও কলকারখানা ঠিকভাবে চলেছে। কিন্তু এখন কিছু মানুষকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর ক্ষতি হচ্ছে। সেটা আমরা করতে চাইনি। এ জন্য আমি স্বীকার করছি, আমাদের সময়ে বিদ্যুতের কিছুটা স্বল্পতা ছিল। কিন্তু আমরা সরকারি বড় প্রকল্পের মাধ্যমে তা উত্তরণের চেষ্টা করছিলাম। পরবর্তী আরেকটা মেয়াদে সরকার গঠন করতে পারলে সেটা আমরা করতে পারতাম।
বর্তমানে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে অর্থ দেওয়া হচ্ছে, সেটা ডলারে পরিশোধ করা হচ্ছে। দেশে এখন ডলার নেই। ডলারের উচ্চ মূল্যের জন্য দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী হয়েছে। এখন টাকা ছাপিয়ে অর্থনীতি চালাচ্ছে। আমাদের সময় তো মানুষের দুর্ভোগ ছিল না। দ্রব্যমূল্য, শেয়ারবাজার, আর্থিক খাত—সবকিছুতেই একটা নিয়ম ছিল। আমাদের সময় দেশের সার্বিক অবস্থা ঠিক রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনে হয়তো কিছুটা সময় নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু তারা তো আজ অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আজ শেষ হয়ে গেছে। ডলার–সংকটের ফলে পণ্য আমদানি হচ্ছে না। শিল্পকারখানাগুলো প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পাচ্ছে না। এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধও আনতে পারছে না। তথাকথিত উন্নয়নের নামে, কিছু লোকের হাতে পয়সা দেওয়ার জন্য দেশকে আজ তারা কোথায় নিয়ে গেছে?
পৃষ্ঠপোষকতার অর্থনীতি ও রাজনীতির মাধ্যমে বর্তমান সরকার টিকে থাকে। সে জন্য বিদ্যুৎ খাত আজ এখানে এসেছে। বিএনপির সামগ্রিক পরিকল্পনা হলো মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বিদ্যুৎ থাকতে হবে। বিএনপি থাকলে এত দিনে বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট হয়ে যেত। বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির ফলে দেশি চক্রের সঙ্গে বিদেশি চক্র ঢুকে পড়েছে। অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতির চর্চা, মুক্তবাজার অর্থনীতির চর্চা—সবকিছু তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। আজ দুর্নীতিতে বিদ্যুতের যে অবস্থা হয়েছে, সেখানে ভর্তুকি দিয়েও কুলানো যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিলের মাধ্যমে দেশের মানুষ এ অর্থ দিচ্ছে।
বাজার অর্থনীতির সঙ্গে মিল রেখে প্রতিযোগিতামূলক বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হয়নি। এ জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করার দরকার ছিল। বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলো ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এসবের অধিকাংশই রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় থাকতে হয়। এই জায়গাটা তারা আজ ছেড়ে দিয়ে দেশটাকে লুটপাট, দুর্নীতির আখড়া করেছে।
অল্প সময়ের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতে পারে। কিন্তু এখন সময় বাড়িয়ে অব্যাহতভাবে তা চালানো হচ্ছে। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হয় এমন বড় প্রকল্পের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। পরিবেশগতভাবে আমরা ঝুঁকিতে আছি। সূর্য, পানি, বাতাস ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে। এখানে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ভাবতে হবে। আজ আমরা গ্যাস উৎপাদন না করে কিছু মানুষকে সুযোগ দেওয়ার জন্য গ্যাস আমদানি করছি। বিদেশি গ্যাসের ওপর নির্ভর করে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটা আমাদের জন্য আরও বিপদ ডেকে এনেছে।
নিজস্ব গ্যাস কতটুকু আছে, কয়লা ব্যবহার করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, নবায়নযোগ্য জ্বালানি কতটুকু ব্যবহার করা যেতে পারে—এর কোনো কিছু না ভেবে কিছু মানুষকে সুযোগ দেওয়ার জন্য তাদের ওপর সব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন গ্যাস, বিদ্যুৎ, কয়লা—সবই আমদানি করা হচ্ছে। দেশের সম্পদ ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে না। এ থেকে বের হতে হলে সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে। পরনির্ভরশীলতা কমাতে হবে। গ্যাস–বিদ্যুৎ বাইরে থেকে আনলেও এর প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
বিএনপির চিন্তা হলো খুব কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি চিন্তা করা। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা। বিদ্যুৎ, পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে। এখানে ব্যক্তি খাত যুক্ত হলেও প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে আসতে হবে।
(সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ২৭ অক্টোবর ২০২৩)