গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালান অরুনা বেগম। প্রতিদিনের মতো রোববার সকালেও ঘুম থেকে উঠে কাজে গিয়েছিলেন। বিকেলে লোকমুখে জানতে পারেন, তাঁর বস্তিতে আগুন লেগেছে। ছুটে গিয়ে দেখেন, দাউ দাউ করে জ্বলছে তাঁর ঘর। তখন অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি। এর মধ্যেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁন্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
রাজধানীর বনানীর গোডাউন বস্তিতে দেখা যায় এ দৃশ্য। বিকেল চারটার দিকে এ বস্তিতে আগুন লাগে। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে। পরে সাড়ে পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। আগুনে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের খবর না পাওয়া গেলেও আর্থিকভাবে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন অরুনা বেগমের মতো বস্তিটির অনেক বাসিন্দা।
আগুন লাগার সময় ঘরে ছিল অরুনার উচ্চমাধ্যমিকে পড়া ছেলে আজিজুল হক। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে ছেলেকে নিয়ে পোড়া ঘরে যান তিনি। সেখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে আছে পোড়া টিন। অরুনা একেকটি টিন সরাতে থাকেন। একপর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে বলেন, ‘ও আজিজুল, তোর বই–খাতা সব পুইড়া গ্যাছে গ্যা। আমাদের ফ্রিজও পুড়ছে। তোর বোনের সোনাও পুইড়্যা গ্যাছে।’
মায়ের কথা শুনে আজিজুলের চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ে। মাটিতে পড়ে থাকা পোড়া বইগুলো তুলতে থাকেন মা ও ছেলে। পোড়া বইয়ের পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে আজিজুলের কান্না বেড়ে যায়। অরুনা তখন ছেলেকে বলেন, ‘ও বাবা আজিজুল, ঘরে রাখা সব টাকাও পুইড়্যা ছাই হইয়া গ্যাছে। তোর বই আবার আমি ক্যামনে কিইন্যা দেব? কোথায় পাব টাকা?’
এরপর অরুনা তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র খুঁজতে থাকেন। তবে পাননি। ছেলে আজিজুলকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, ‘অনেক কষ্টের জীবন আমার। দুই ছেলে আর এক মেয়ে যহন ছোট, তখন স্বামী হঠাৎ স্ট্রোক কইর্যা মারা যায়। এরপর বাসাবাড়িতে কাম কইর্যা ছেলেমেয়েদের বড় কইর্যা তুলছি।’
অরুনার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী। তাঁর স্বামী উজির আলীর বাড়ি সিলেটে। পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর অরুনা স্বামীর বাড়িতে সংসার শুরু করেন। ছোট ছোট সন্তান রেখে স্বামী মারা যাওয়ার পর চরম বিপাকে পড়েন তিনি। সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। বসবাস শুরু করেন এই বস্তিতে। দিনের পর দিন পরের বাসায় কাজ করেই ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন।
অরুনা জানান, তাঁর স্বপ্ন ছিল, যত কষ্টই হোক ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাবেন। বড় ছেলেকে বেশি দূর লেখাপড়া করাতে পারেননি। তাঁকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে আজিজুলের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ আছে। তাই তাকে সঙ্গে নিয়েই থাকেন কড়াইল বস্তিতে।
আজিজুল গত বছর বনানীর বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেছে। সে এখন ওই কলেজেই উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। এখন ঘর পুড়ে যাওয়ায় আজিজুলের লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তা ছেয়ে ধরেছে অরুনাকে। একার আয়ে নতুন করে সবকিছু কিনে ছেলের লেখাপড়া চালাবেন কীভাবে, তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। পুড়ে যাওয়া শোবার খাটটি দেখিয়ে বলেন, ‘আমাদের তো সব পুইড়া গেছে গ্যা। ওহন আমরা কই থাকুম, কী খামু, ছেলের লেখাপড়া খরচ দেব ক্যামনে?’
আর পোড়া বইয়ের পৃষ্ঠা হাতে অসহায় আজিজুলের তখন বুক ভরা হতাশা। বলল, ‘মা আমার সব। মা দিনরাত কাজ করে আমার লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন। বই কিনে দিয়েছেন। আগুন আমাদের পথে বসিয়ে দিল। আগে মাথা গোঁজার ঠাই ছিল, এখন তা–ও নেই। কোথায় থেকে লেখাপড়া করব, জানি না। বই কবে হাতে পাব, জানি না। জানি না, আর লেখাপড়ায় ফিরতে পারব কি না?’