কারাবন্দী খাদিজাতুল কুবরা

‘হয়নি জামিন, হয়নি বিচার: অবিচারের ৩৬৫ দিন’

খাদিজাতুল কুবরার নিঃশর্ত মুক্তি চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পায়রা চত্বরে সংহতি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ঢাকা, ২৭ আগস্ট
ছবি: আশরাফুল আলম

কারাবন্দী খাদিজাতুল কুবরার নিঃশর্ত মুক্তি চেয়ে আয়োজিত সংহতি সমাবেশের ব্যানারে লেখা ছিল ‘হয়নি জামিন, হয়নি বিচার: অবিচারের ৩৬৫ দিন’। সেখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের কারও কারও হাতে ছিল পোস্টার, তাতে লেখা ‘ফ্রি খাদিজাতুল কুবরা’। সমাবেশস্থলের পাশে সাদা কাপড়ে একজন শিল্পী এঁকে চলছিলেন খাদিজার মুখের প্রতিকৃতি।

রোববার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পায়রা চত্বরে অনুষ্ঠিত এই সংহতি সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংগীতশিল্পীসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা। অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনেরা বলেন, বাংলাদেশ এখন কী বাস্তবতার মধ্যে আছে, খাদিজাতুল কুবরাকে এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখার ঘটনাটি তার সামান্য উদাহরণ। এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এই ঘটনা একই সঙ্গে প্রমাণ করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিরাপত্তা আইন কতটা নিবর্তনমূলক। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর প্রতি শুধু অন্যায়ই করা হচ্ছে তা নয়, দেশে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কী অবস্থা, সেই চিত্রও এ ঘটনাটি তুলে ধরেছে।

সংহতি সমাবেশে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয়। তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘খাদিজার গ্রেপ্তারের ঘটনাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে নিবর্তনমূলক এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী, সেটির একটি ন্যক্কারজনক প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের জন্য সুদীর্ঘ লড়াই করা সৃষ্ট একটি দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়, তখন দেশে এমন আইন বিদ্যমান আছে, এটি বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।’

অনতিবিলম্বে খাদিজার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, ‘খাদিজাকে কালাকানুনে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘদিন বন্দী রাখা, খাদিজার বিকাশমান জীবনকে এমন অন্যায়ভাবে বিকৃত করায় একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা চাই খাদিজাকে অবিলম্বে মুক্তি দেবেন, খাদিজা যেন পড়াশোনাসহ তাঁর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পান।’

অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচার এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজাতুল কুবরা এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কলাবাগান ও নিউমার্কেট থানায় পৃথক দুটি মামলা করে পুলিশ। গত বছরের ২৭ আগস্ট নিউমার্কেট থানার মামলায় মিরপুরের বাসা থেকে খাদিজাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনলাইনের যে অনুষ্ঠানে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন খাদিজা। তখন তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন।

সংহতি সমাবেশে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে বলা আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলা এক জিনিস নয়। কিন্তু এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে। নিবর্তনমূলক আইনে খাদিজাকে দীর্ঘ সময় জেলে রেখে তাঁর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে।

দেশের শাসনব্যবস্থাকে নিপীড়নমূলক বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খান। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে দমনমূলক ব্যবস্থা কার্যকর করেছে।

বাংলাদেশ কী বাস্তবতার মধ্যে আছে, খাদিজার ঘটনাটি তার সামান্য উদাহরণ বলে সংহতি সমাবেশে উল্লেখ করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, একটি অনলাইন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছিলেন খাদিজা। ওই অনুষ্ঠানের অতিথিরা সরকারের বিরোধিতা করেছেন। এর দায় পড়েছে খাদিজার ওপর। মামলায় খাদিজার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, সরকার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা, সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টার। গণতন্ত্র আছে এমন দেশে প্রকাশ্যে জনগণকে সংগঠিত করে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা সাংবিধানিক অধিকার। সেখানে খাদিজাকে রাতে ধরে নিয়ে আসতে হলো, তাঁকে জেলখানায় নেওয়া হলো, তাঁকে জামিন দেওয়া হলো না। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় একটি নমুনা এটি।

সমাবেশে খাদিজার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, চলচ্চিত্র নির্মাতা আশফাক নিপুণ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি সাদেকুল ইসলাম, ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি মাঈন আহমেদ। অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

খাদিজার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

খাদিজাতুল কুবরার মুক্তির দাবিতে রোববার দুপুরে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

খাদিজার শিক্ষাজীবন ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে সমাবেশে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশনের (জেইউডিও) সাধারণ সম্পাদক প্রাপ্তি তাপসী দে বলেন, শুধু একজন উপস্থাপক হওয়ায় খাদিজাকে ৩৬৫ দিন জেলে থাকতে হচ্ছে। খাদিজার প্রশ্নগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকের করার অধিকার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। রাষ্ট্রের কোথায় এত ভয়? প্রতিটা জায়গায় বিরুদ্ধ মতকে গলা টিপে হত্যা করা হয়।

জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, খুনের আসামিও জামিন পান, কিন্তু খাদিজা পান না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আসলে ক্ষমতাসীনদের জন্য।

সমাবেশ সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি সংগঠন ‘ধ্বনি’র সহসাংগঠনিক সম্পাদক ফাইজা মেহজাবিন। সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সহসাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী বলেন, ‘নাম বদলে, সাজা কমিয়ে-বাড়িয়ে, জরিমানা কমিয়ে-বাড়িয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকেই যাচ্ছে। আমরা এটার বাতিল চাই।’