জেনেভায় জেআরপি বৈঠক কাল

বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গা সংকট যেন বিশ্বমনোযোগ থেকে না সরে

  • জেনেভায় জেআরপি নিয়ে কাল বৈঠক, এবার চাওয়া হচ্ছে ৮৭ কোটি ডলার

  • গতবার পূরণ হয়েছে প্রতিশ্রুত অর্থের ৬২ শতাংশ

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির

রাশিয়া-ইউক্রেনকে ঘিরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এরই মধ্যে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গাদের জন্য মাথাপিছু খাদ্যসহায়তা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে আগামীকাল মঙ্গলবার জেনেভায় অনুষ্ঠেয় উন্নয়ন সহযোগীদের বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট যেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ থেকে সরে না যায়, সে বিষয়টিতে অগ্রাধিকার থাকবে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের গণহত্যা থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলতি বছরের মানবিক সহায়তার জন্য ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের প্রয়োজন। জেনেভায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার উদ্যোগে অনুষ্ঠেয় উন্নয়ন সহযোগীদের বৈঠকে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ওই সহায়তা চাওয়া হবে।

জেআরপি নিয়ে জেনেভার বৈঠকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি অবশ্য বলছেন, ৭ মার্চ জেনেভায় রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তার প্রকল্প যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা (জেআরপি) প্রকাশ করা হবে। জেআরপির বিস্তারিত প্রকাশের পর বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর গত বছর জেআরপিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা ছিল সর্বনিম্ন। ২০২২ সালের জেআরপিতে প্রতিশ্রুতির মাত্র ৬২ শতাংশ পূরণ করেছে উন্নয়ন সহযোগীরা। এর আগে ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালে যথাক্রমে চাহিদার ৭৩, ৭২, ৭৫, ৬৫ এবং ৭২ শতাংশ অর্থসহায়তা পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটি যেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভাবনা থেকে দূরে সরে না যায়, সে আহ্বানটি থাকবে। রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তার পাশাপাশি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আবারও আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাইব। গত বছর জেআরপিতে যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তার ৬২ শতাংশ পূরণ হয়েছে। ফলে এবার আমাদের আহ্বান থাকবে, অঙ্গীকারের হার যেন ৬২–এর বেশি হয়।’

ডব্লিউএফপি এরই মধ্যে তহবিল কমানোর কথা ঘোষণা করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কী বলা হবে, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আর্থিক সহায়তার বর্তমান ধারা চলতে থাকলে মে মাস পর্যন্ত ডব্লিউএফপি জনপ্রতি খাদ্যসহায়তা অর্ধেকে নেমে আসার যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তা আসলেই ভয়ংকর। আশা করছি, বিষয়টি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পক্ষ থেকে তোলা হবে। আর আমাদের প্রস্তাব থাকবে, কক্সবাজারে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার যে প্রশাসনিক খরচ, তা কমিয়ে আনতে যতটা সম্ভব স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থাপনার। কারণ, আমাদের বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলো দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে কাজ করছে। কাজেই বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করার মাধ্যমে খরচের সাশ্রয় হবে। ফলে ওই অর্থ খাবারের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি গত বছর থেকে চালু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের খাতে ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাবে।’

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সবশেষ অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছিল। এর পর থেকে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা মিলে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তার প্রকল্প জেআরপি চালু করে। ২০১৭ সাল থেকে জেনেভায় উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে বৈঠকের মাধ্যমে চলতি বছরের জন্য সহায়তার খসড়া উপস্থাপন করে তহবিল চাওয়া হয়।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের খসড়া জেআরপিতে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী মিলিয়ে মোট ১৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের সহায়তা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী মিলিয়ে ১৪ লাখ ৭৩ হাজার মানুষের জন্য ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৮৭৬ মিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। এর মধ্যে কক্সবাজারের জন্য ৮০ কোটি ডলারের বেশি এবং ভাসানচরের জন্য ৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারের বাজেট ধরা হয়েছে।

২০২২ সালের পর এবার দ্বিতীয়বারের মতো ভাসানচরের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত বছর ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের জন্য ১০ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছিল। এবার ভাসানচরের ৭৫ হাজার রোহিঙ্গার জন্য ৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার চাহিদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে দ্বীপটিতে ২৯ হাজার ৩৪০ জন রোহিঙ্গা রয়েছে।

খসড়া জেআরপিতে এবার কৌশলগত পাঁচটি লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—টেকসই ও স্বেচ্ছামূলক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে কাজ করা, রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা জোরদার করা, জীবন রক্ষার স্বার্থে সহায়তা প্রয়োজন এমন লোকজনের সাহায্য নিশ্চিত করা, উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় লোকজনের উন্নত জীবনের লক্ষ্যে কাজ করা,  প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকির ব্যবস্থাপনা জোরদার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করা। এ পাঁচ লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ১১৬টি সংস্থাকে নিয়ে ১৬০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের জেআরপিতে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে সংহতি স্থাপনের বিষয়টিতে জোর দিয়েছিল জাতিসংঘ। তবে এ বছরের জেআরপির কৌশলগত লক্ষ্য থেকে দুই পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্কের বিষয়টি বাদ গেছে।

রোহিঙ্গা ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে সংহতির বিষয়টি বাদ যাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এমনিতেই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গা সংকট অনেকটা পেছনে চলে গেছে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তহবিলও কমেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে তহবিল কমানোর কথা জানিয়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে খাদ্য, পুষ্টির মতো বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর গত বছর জেআরপিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা ছিল সর্বনিম্ন। এর সবচেয়ে কম এসেছিল। ২০২২ সালের জেআরপিতে প্রতিশ্রুতির মাত্র ৬২ শতাংশ পূরণ করেছে উন্নয়ন সহযোগীরা। এর আগে ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালে যথাক্রমে চাহিদার ৭৩, ৭২, ৭৫, ৬৫ এবং ৭২ শতাংশ অর্থ সহায়তা পাওয়া গেছে।