কর্ণফুলী গ্যাস

জালিয়াতি করে গ্যাসের চুলা বাড়াতে যত কাণ্ড

এক গ্রাহকের নামে গ্যাসের চুলা ছিল চারটি। অবৈধ উপায়ে ৪ চুলা করা হয় ২৭টি। বদলে ফেলা হয় নামা–ঠিকানাও। বিপত্তি বাধল এই জালিয়াতি জায়েজ করতে গিয়ে। এখন যেহেতু নতুন সংযোগ বন্ধ, তাই আগের তারিখে সংযোগ বর্ধিত দেখাতে হয়েছে। তা করার জন্য তৈরি করতে হয়েছে আগের তারিখের ভুয়া বিল। এটা করতে গিয়ে আরও ৭৪৫ জন গ্রাহকের বিলেও গরমিল করতে হলো। করণ, গ্যাসের বিল গ্রুপ ভিত্তিতে হয়, একক নয়। অথচ তাঁরা নিয়মিত বিল দিয়েছেন। এ রকম এক গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে ধরা পড়ে এই জালিয়াতি।

এই জালিয়াতি হয়েছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে (কেজিডিসিএল)। মো. আমির সাফা নামের এক গ্রাহকের চুলা নিয়ে এই কাণ্ড। তিনি ১৯৮৬ সালে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেড (বর্তমানে কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি) থেকে গ্যাস–সংযোগ নিয়েছিলেন। চলতি বছরের মে মাসের শেষ দিকে এ জালিয়াতি করা হয়। জুন মাসে ৭৪৫ জনের মধ্যে এক গ্রাহক গ্যাস বিল পরিশোধ করতে গিয়ে দেখেন, তাঁর বাড়তি বিল এসেছে। তিনি প্রতি মাসে চার চুলার জন্য ৪ হাজার ৩২০ টাকা বিল পরিশোধ করেন। কিন্তু মে মাসে তাঁর বিল আসে সব মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকা। বাড়তি বিলের বিষয়টি তিনি কেজিডিসিএলের আইটি বিভাগের এক কর্মকর্তাকে জানান। পরে ওই গ্রাহকের অভিযোগের সূত্র ধরে চুলা বাড়াতে সফটওয়্যারে নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করা, চুলার সংখ্যা বৃদ্ধি করা ও বিল তৈরির এসব তথ্য বের হয়ে আসে। এরপর ৭ জুন তড়িঘড়ি করে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করা হয়। এ ঘটনায় গত ১১ জুন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে আহ্বায়ক করা হয় কেজিডিসিএলের উপমহাব্যবস্থাপক মো. নাহিদ আলমকে। কমিটির সদস্যরা হলেন ব্যবস্থাপক মাহমুদুল ইসলাম ও সুলতান আহম্মেদ। কমিটি ১২ জুলাই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

যা ঘটেছিল, যাঁরা জড়িত

কেজিডিসিএলের পাঁচ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান, মো. আমির সাফার কাছ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে ভবনসহ জায়গা কিনে নিয়েছিলেন কয়েকজন ব্যক্তি। তাঁর মধ্যে ফয়জুন্নেসা চৌধুরীর নামে সংযোগটি স্থানান্তরের চেষ্টা করা হয়। তাঁরা সবাই মিলে নগরের বায়েজিদ এলাকায় একটি ভবন নির্মাণ করছেন। নির্মাণকাজ এখনো চলছে। ওই ভবনে ২৭টি দ্বৈত চুলার প্রয়োজন। কিন্তু অনুমোদন ছিল চারটির। তাই চুলা বাড়াতে অবৈধ উপায়ে পুরোনো তারিখের বিল তৈরি করেছেন কর্মকর্তারা। এ কাজে সফল হলে পরে চুলার সংযোগ দেওয়া হতো। নাম, ঠিকানা, সরঞ্জাম ও বিল সম্পর্কিত তথ্য ৩০ মে ও ৩১ মে অনলাইন সফটওয়্যারে পরিবর্তন করা হয়।

কেজিডিসিএলের বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে টাকার বিনিময়ে চুলা বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে পেট্রোবাংলার এক তদন্তেও অনিয়ম করে গ্যাস–সংযোগ দেওয়ার তথ্য বের হয়ে এসেছিল।

কেজিডিসিএলের আইটি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি মাসে গ্যাস বিল পরিশোধের জন্য গ্রাহকের নামে বিল তৈরি হয়। সফটওয়্যারের মাধ্যমে এটি করা হয়। তবে এক গ্রাহকের বিল এককভাবে তৈরির সুযোগ অনলাইন সফটওয়্যারে নেই। এ কারণে ফয়জুন্নেসা চৌধুরীর নামে ২৭টি চুলার বিল তৈরি করতে গিয়ে বিপত্তিটা বেঁধেছে। তাঁর সঙ্গে আরও ৭৪৫ জনের ২০১৬ সাল থেকে প্রায় ২ হাজার ৭০০ মাসের বিল পুনরায় তৈরি হয়ে গেছে। যেটিকে গ্রুপ বিল বলা হয়।

প্রাথমিকভাবে উত্তর বিভাগের (রাজস্ব) জোন ৩ ও ৯ শাখার ব্যবস্থাপক রোকেয়া ফেরদৌসী, একই বিভাগের উপব্যবস্থাপক শাহাদাত ওসমান খান ও আইটি বিভাগের উপব্যবস্থাপক আবদুল মমিনের বিরুদ্ধে চুলা বাড়ানোর জন্য সফটওয়্যারে বিল তৈরির কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ওই তিন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ১১ জুন প্রশাসন বিভাগে যুক্ত করা হয়। পরে তদন্তে রোকেয়া ও শাহাদাত ওসমানের নাম বাদ গেছে।

তদন্ত সূত্র জানায়, প্রাথমিক তদন্তে দুজন কর্মকর্তা বিল তৈরির এ অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন, এমন প্রমাণ মিলেছে। আবদুল মমিন ছাড়া অন্য আরেকজন হলেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বীরেন্দ্র তাঁতি। অফিসের ভিডিও ফুটেজ, সফটওয়্যারে প্রবেশের আইডি ও পাসওয়ার্ড এবং সফটওয়্যারের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দুজনের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে কেজিডিসিএল। তবে রোকেয়া ফেরদৌসী ও শাহাদাত ওসমানের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হলেও, তাঁরা ঘটনার সময় অফিসে ছিলেন না। কোম্পানির তিন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি চুলা বাড়ানোর জন্য অন্তত এক লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল জড়িত কর্মকর্তাদের।

এ ব্যাপারে মূল গ্রাহক আমির সাফার কাছ থেকে জায়গা কেনা ফয়জুন্নেসা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জায়গার ক্রেতাদের আরেকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। টাকার বিনিময়ে গ্যাসের চুলা বাড়ানোর বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।

কিন্তু অভিযুক্ত বীরেন্দ্র তাঁতির দাবি, তিনি অবৈধ বিল তৈরির বিষয়ে কিছুই জানেন না। অন্যদিকে আবদুল মমিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, তাঁকে ফাঁসাতে কেউ তাঁর কম্পিউটারের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেছেন। তিনিও এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না।

কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে অবৈধভাবে গ্যাস–সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ পুরোনো। আগে থেকে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে এসব ঘটনা কমে আসত। কিন্তু কারও বিরুদ্ধেই শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
আখতার কবির চৌধুরী, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), চট্টগ্রাম

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক উপমহাব্যবস্থাপক মো. নাহিদ আলম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে দুজন জড়িত থাকার বিষয়ে তাঁরা জেনেছেন। প্রতিবেদন প্রশাসন বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এখন পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।

জানতে চাইলে কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে তাঁর কার্যালয়ে বলেন, অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা প্রক্রিয়াধীন।

নাম ছিল বকেয়াধারীর তালিকায়ও

চট্টগ্রামে অন্তত এক হাজার গ্রাহকের কাছে গ্যাস বিল বাবদ বকেয়া পড়ে আছে ৭২০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে আবাসিকে বকেয়া ১১৮ কোটি টাকা। মূল গ্রাহক মো. আমির সাফা ছিলেন বকেয়াধারীদের একজন। জায়গা বিক্রি করলেও আমির সাফার নামেই চলছিল গ্যাস–সংযোগটি। সংযোগের মালিকানায় কোনো নাম এখনো পরিবর্তন করা হয়নি।

তদন্ত সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো টাকাই পরিশোধ করা হয়নি। এ জন্য আমির সাফার নামে বকেয়া আছে ৬ লাখ ৭০ হাজার ৪১০ টাকা। তবে সফটওয়্যারে ভুয়া বিল তৈরির সময় বকেয়া রাখা হয়নি। সফটওয়্যারে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গ্যাস বিল বাবদ ৭ লাখ ৬৮ হাজার ২৮৫ টাকা ও সারচার্জ বাবদ ১৫ হাজার ১২০ টাকা পরিশোধিত দেখানো হয়েছে। যদিও কোনো টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়নি।

‘দুদকের তদন্ত করা উচিত’

২০১৫ সাল থেকে সরকার আবাসিক বাসাবাড়িতে গ্যাস–সংযোগ বন্ধ করে রেখেছে। ফলে এখন কেউ বৈধভাবে নতুন সংযোগ নিতে পারবে না। বাড়াতে পারবে না চুলাও। তবে কেজিডিসিএলের বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে টাকার বিনিময়ে চুলা বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে পেট্রোবাংলার এক তদন্তেও অনিয়ম করে গ্যাস–সংযোগ দেওয়ার তথ্য বের হয়ে এসেছিল। নিয়ম না মেনে শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে গ্যাস–সংযোগ দেওয়া, বোর্ডের অনুমোদন না নিয়ে পুনঃসংযোগ দেওয়াসহ নানা ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছিল পেট্রোবাংলা।

অনিয়মের ঘটনায় গত বছরের ২৩ নভেম্বর তৎকালীন কোম্পানি সচিব ফিরোজ খানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সিরাজগঞ্জে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। আর ১৯ নভেম্বর পেট্রোবাংলায় পাঠানো হয় তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ মাজেদকে।

এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনো দক্ষ কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত করানো উচিত বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে অবৈধভাবে গ্যাস–সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ পুরোনো। আগে থেকে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে এসব ঘটনা কমে আসত। কিন্তু কারও বিরুদ্ধেই শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। অন্তত এ ঘটনায় তদন্ত করে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।