হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কারা হামলা করে

সাম্প্রতিক কালে নড়াইলসহ বাংলাদেশের কিছু জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কয়েকটি আক্রমণের খবর এসেছে। সাম্প্রদায়িকতা দেশের বাম প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরের দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার বিষয়। পাকিস্তান শাসনামলে প্রকাশিত সাম্প্রদায়িকতা তাঁর বহুল আলোচিত একটি গ্রন্থ। পরেও বিষয়টি নিয়ে তিনি লিখেছেন। বর্তমান লেখাটি সে ধারাবাহিকতারই অংশ। বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলো আরও পর্যালোচনামূলক লেখা প্রকাশে আগ্রহী।

বদরুদ্দীন উমর

কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের কিছু জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ঘটনা হলো ১৫ জুলাই ২০২২ তারিখে নড়াইল জেলার লোহাগড়ার সাহাপাড়া গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়ি, মন্দির, দোকানপাটের ওপর আক্রমণ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি। এ ধরনের আক্রমণের প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বলা হয়, ফেসবুকে কোনো হিন্দু ব্যক্তির ইসলামবিরোধী বক্তব্যে ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানদের ‘ধর্মীয় অনুভূতি’তে আঘাত লেগেছিল। কোনো হিন্দু ব্যক্তি বিচ্ছিন্নভাবে কেন ও কী কারণে হঠাৎ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করবে, তার ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে ফেসবুকে এ রকম কোনো আদৌ লেখা হয়েছে, সেটা যাচাই করে দেখার ঘটনা ঘটে না।

এ পর্যন্ত এ ধরনের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাউকেও কেউ পাগল হিসেবে শনাক্ত করেনি। সে অনুযায়ী বলা যায়, ফেসবুক ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা মানসিকভাবে সুস্থ। সামান্য হলেও শিক্ষাদীক্ষা থাকা মানসিকভাবে সুস্থ একজন হিন্দু ব্যক্তি কি জানে না যে ফেসবুকে ইসলামের বিরুদ্ধে কটূক্তি করলে তার এলাকার মুসলমানদের মধ্যে এর বিরুদ্ধে কেমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে? তার নিজের কী বিপদ ঘটতে পারে? সে কি এ আশঙ্কার কথা একবারও না ভেবে নিশ্চিন্তে ইসলামের বিরুদ্ধে এভাবে কটূক্তি করতে পারে?

এটা বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যাপার নয়। দেখা যায় যে একটা এলাকায় হঠাৎ ফেসবুকে কোনো হিন্দু ব্যক্তির ইসলামবিরোধী বক্তব্যের কথা বলে স্থানীয় কিছু মুসলমান আওয়াজ তোলে, হইচই শুরু হয়, কিন্তু তার সত্যাসত্য যাচাইয়েরই কোনো প্রয়োজন কারও হয় না।

নড়াইলের লোহাগড়ার সাহাপাড়ায় মেরামত করা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত গোবিন্দ সাহার বাড়ি। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন

এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় কিছু ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিশালী লোক মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা বলে লোকজন জড়ো করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে। তাদের বাড়িঘর, মন্দির, দোকান লুটপাট করে এবং জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের ঘরছাড়া করে। চেষ্টা করে তাদের সম্পত্তি দখল করতে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের কারণে ঘটনাগুলোকে আপাতদৃষ্টে সাম্প্রদায়িক বলে মনে হলেও এগুলোকে সাম্প্রদায়িক বলা চলে না। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে লুটপাটের যে রাজত্ব শুরু হয়ে ৫০ বছর ধরে চলে আসছে, এগুলো সেই রকমেরই ব্যাপার। বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত এবং সচেতন, তাঁরা জানেন, শাসকশ্রেণির অন্তর্গত এবং তাদের বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু লোক জাতিধর্ম–নির্বিশেষে অবাধে এবং কোনো শাস্তির ভয়ে ভীত না হয়ে হিন্দু, সাঁওতাল, গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি গোষ্ঠীর জমিজমা, সম্পত্তি, বাড়িঘর লুটপাট করে আসছে। এ ক্ষেত্রে মুসলমানদেরও যে ছাড় দেওয়া হয়, তেমন নয়।

মুসলমানরাও যেখানে দুর্বল, সেখানে তাদেরও জমিজমা, ধনসম্পত্তির ওপর আক্রমণের ঘটনার প্রতিবেদন প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায়। কারণ, যারা লুণ্ঠনকারী ও লুণ্ঠনজীবী, তাদের কাছে জাতি বা ধর্ম ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক। যাদের সম্পত্তি লুটপাটের আশঙ্কা থাকে, যারা দুর্বল, তাদের সম্পত্তিই এরা লুটপাট করে। বাংলাদেশের এই সামগ্রিক পরিস্থিতির দিকে না তাকিয়ে, তার হিসাব না করে উপরোক্ত ধরনের ঘটনাকে সাধারণভাবে লুণ্ঠনজীবীদের অপরাধমূলক কার্যকলাপ না ভেবে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ মনে করা বড় রকমের ভ্রান্তি।

বলা হয়েছে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যেভাবে আক্রমণ হচ্ছে, সে ধরনের আক্রমণ অন্যদের ওপরও হচ্ছে। কাজেই এসব আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক বলার আগে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিরাজ করে কি না, সেটা দেখা দরকার। কারণ, একটি দেশে যদি সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিরাজ না করে, তাহলে উপরোক্ত ধরনের লুণ্ঠনজীবীদের আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক বলা হবে সত্যের বড় রকম অপলাপ।

বিদ্যমান সামাজিক পরিস্থিতির দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে যদি কেউ সাম্প্রদায়িক বলেন, তাহলে সেটা এ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে বড় রকম অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু হবে না।

দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলার ঘটনায় শাহবাগে প্রতিবাদ

মনে রাখা দরকার, সাম্প্রদায়িকতা ব্রিটিশ আমলের উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জন্ম লাভ করা এক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বিশ শতকের প্রথম থেকে পুরোপুরি রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করে। এ কারণে সাম্প্রদায়িকতা কোনো প্রকৃত ধর্মীয় ব্যাপার নয়। এর সঙ্গে ধর্মচর্চার কোনো সম্পর্ক নেই। সাম্প্রদায়িক লোকেরা যে ধার্মিক তা বলা যাবে না। এটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের ঐহিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত। ব্রিটিশ ভারতে এ দ্বন্দ্ব থেকেই জন্মলাভ করেছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর এ দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে হিন্দু–মুসলমান সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু আধিপত্যের অবসানের পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবর্তে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে তার বড় ধরনের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। এ প্রক্রিয়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে একটা পরিণতি লাভ করে। বাংলাদেশ কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। এটি বাঙালিদের রাষ্ট্র, যার একাংশ হিন্দু।

বাঙালিদের এ রাষ্ট্রে মুসলমানদের মতো হিন্দুরাও, ধর্মীয় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, শাসকশ্রেণির লোক। উর্দুভাষী মুসলমান, পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতি এবং সাঁওতাল, মুণ্ডা, গারো, হাজং ইত্যাদি সম্পর্কে এটা বলা যাবে না। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের। চাকরি, ব্যবসা–বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অংশ এ হারের চেয়ে বেশি। সরকারি আমলা, পুলিশ, র‌্যাব, সামরিক বাহিনী, শিল্প, সংস্কৃতি, ব্যবসা–বাণিজ্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের উপস্থিতি ভালো থাকলেও পাহাড়িদের ছিটেফোঁটা উপস্থিতি ছাড়া অন্য সংখ্যালঘুদের দেখা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থাকলে হিন্দুদের এমন অবস্থা কি সম্ভব হতো? এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ।

কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা হয়েছে

কিন্তু তাদের চাকরি ২ শতাংশের বেশি নয়। লক্ষ করার বিষয়, মুসলমানদের এ অবস্থা হওয়া সত্ত্বেও তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা ও জীবনের ওপর সেখানে হামলা নেই। কারণ, সেখানকার শাসকশ্রেণি বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির মতো লুণ্ঠনজীবী নয়। তারা হলো সুগঠিত বুর্জোয়া শ্রেণি। তারা শোষক হলেও চরিত্রগত কারণে অন্যদের ওপর হামলা করে না, যে ধরনের হামলা লুণ্ঠনজীবীদের দ্বারা হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ভারতের মতো বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি সাম্প্রদায়িক নয়। এ জন্য বাংলাদেশে মুসলিম লীগের মতো কোনো সাম্প্রদায়িক দল নেই। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ইত্যাদি রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িক নয়। তারা ইসলামি মৌলবাদী, দেশে কোরআন–সুন্নাহর ভিত্তিতে শাসন প্রতিষ্ঠাই তাদের ঘোষিত লক্ষ্য। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কিছু বলে না। তারা গণতন্ত্র, সাম্যবাদ ইত্যাদি সব ধরনের প্রগতির শত্রু। তাদের শত্রু হিন্দু সম্প্রদায় নয়, তাদের শত্রু কমিউনিস্ট, গণতন্ত্রী এবং যেকোনো ধরনের প্রগতিবাদীরা।

সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। এ জন্য একটি দেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকলে সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি থাকতেই হবে। ভারত তার এক বড় উদাহরণ। ভারতের শাসকশ্রেণি ভয়াবহভাবে সাম্প্রদায়িক। এ কারণে সেখানে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, শিবসেনার মতো বৃহৎ, শক্তিশালী ও বিপজ্জনক রাজনৈতিক দল।

বাংলাদেশের সমাজভূমিতে সাম্প্রদায়িকতার বাস্তব শর্ত অপসারিত হয়েছে। এ জন্য ব্যাপক জনগণের মধ্যে আগের মতো সাম্প্রদায়িকতা নেই। একই কারণে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণিও সাম্প্রদায়িক নয়। বাংলাদেশ ধর্মের ধ্বজাধারীদের রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশ হলো ব্যবসায়ী বুর্জোয়া–শাসিত লুণ্ঠনজীবীদের রাষ্ট্র। এই লুণ্ঠনজীবীরা ধর্মনিরপেক্ষ। এরা দেশজুড়ে দুর্বল সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের জমিজমা, বাড়িঘরসহ সব রকম সম্পত্তি লুটপাট করছে। পাহাড়ি অঞ্চলের জনগণ ও সাঁওতাল, গারো, হাজং, মুসলমান অবাঙালি ইত্যাদি সমতলভূমির সংখ্যালঘু লোকদের ওপর এরা নিয়মিত হামলা চালায়।

তবে সেসব নিয়ে কম খবরই প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া তা নিয়ে কোনো হইচই হয় না, যেমনটা হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কোনো আক্রমণ হলে। কারণ, হিন্দুদের আছে ভারত রাষ্ট্র। তা ছাড়া ভারতীয় জনগণের না হলেও বাংলাদেশে ভারত রাষ্ট্রের এবং তার সরকারের বন্ধুর কোনো অভাব নেই। এ কারণে অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হলে তাকে ‘সাম্প্রদায়িক হামলা’ বলে তার বিরুদ্ধে কোনো হইচই না হলেও, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হলে বিবৃতি, সভা–সমিতি, মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে সেটা হয়ে থাকে।

কিছু বুদ্ধিজীবী তাকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে উচ্চকণ্ঠ হন। অন্যদিকে লক্ষ করার বিষয়, দেশে জনগণের ওপর সামগ্রিকভাবে যে নির্যাতন চলে, তাদের ওপর যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, দেশে হিন্দু–মুসলিমনির্বিশেষে গরিবদের ওপর যে শোষণ চলে, সেটার বিরুদ্ধে তাঁদের দাঁড়াতে দেখা যায় না। ২০১৪ সালের ১৪ জুন ঢাকার মিরপুরে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য জমি দখলের উদ্দেশ্যে তাঁর লোকজনকে দিয়ে বিহারিদের বস্তি আক্রমণ করে আগুন দিয়েছিলেন। এতে এক পরিবারের ১০ জন পুড়ে মারা যায়। সে সময় এই উচ্চকণ্ঠ অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিদের তাঁর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে বা কোনো রকম প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।

সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। এ জন্য একটি দেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকলে সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি থাকতেই হবে। ভারত তার এক বড় উদাহরণ। ভারতের শাসকশ্রেণি ভয়াবহভাবে সাম্প্রদায়িক। এ কারণে সেখানে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, শিবসেনার মতো বৃহৎ, শক্তিশালী ও বিপজ্জনক রাজনৈতিক দল।

বাংলাদেশে অবাঙালি সংখ্যালঘুদের ওপর যে আক্রমণ ও নির্যাতন হচ্ছে, তার তুলনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের পরিমাণ অনেক কম। অবশ্য পরিমাণ কম হলেও স্থানীয় লুণ্ঠনজীবীরা যেখানেই সুযোগ পায়, সেখানেই গরিব ও অসহায় হিন্দুদের ওপর নানা অসিলায় আক্রমণ করে, তাদের জমিজমা, ঘরবাড়ি, সম্পত্তি লুটপাট করে। এটা তারা কোনো ধর্মীয় কারণে করে না, যদিও আজকাল ফেসবুকে গল্প তৈরি করে এগুলোকে ধর্মীয় চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা হয়ে থাকে।

‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ লাগার কথা বলে যারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এভাবে আক্রমণ করে, তাদের দিকে তাকালেই দেখা যাবে ধর্মের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, তারা ধর্মীয় জীবন যাপন করে না, তারা মূলত স্থানীয় লুণ্ঠনকারী ও দুর্নীতিবাজ। ফেসবুক হয়ে দাঁড়িয়েছে বিগত ১৯৯০–এর দশক থেকে জেলহাজতে হার্টফেল বা রাস্তায় র‍্যাব–পুলিশের ক্রসফায়ার ইত্যাদির মতো ব্যাপারে। ফেসবুকের ব্যাপারটি সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ, এখানে মিথ্যার মাধ্যমে জনগণের একটা অংশকে বিভ্রান্ত করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা যায়।

বাংলাদেশে শাসকশ্রেণির মুসলমান বাঙালিদের প্রধান অংশ মনে করে, গরিব শ্রমজীবী মুসলমানদের ওপর যে শোষণ–নির্যাতন চলছে, তার দিকে চোখ বুজে থাকা সম্ভব নয়; তেমনই শাসকশ্রেণির হিন্দু বাঙালি অংশ মনে করে, তাদের ওপর যে আক্রমণ ও হামলা মাঝেমধ্যে হচ্ছে, তার দিকেও চোখ বুজে থাকা যায় না। তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দরকার। এ ক্ষেত্রে প্রতিবাদের নামে এক দল বুদ্ধিজীবী এ ধরনের ঘটনাকে প্রায়ই যেভাবে উপস্থিত করে থাকেন, তা চরম বিভ্রান্তিকর। প্রকৃতপক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রতিরোধে তা কোনো পথ নয়। উপরন্তু এর দ্বারা এক কল্পিত শত্রুকে সামনে খাড়া করে আসল শত্রু ও অপরাধীদের আড়াল করা হয়; সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টিরই চেষ্টা হয়। তাঁরা যেভাবে এ কাজ করেন, তাতে মনে হয় এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁরা মাঠে নামার অপেক্ষায় থাকেন। দেশে অন্য বহু ব্যক্তি বা সংস্থা এর বিরুদ্ধে যেভাবে দাঁড়ায়, তার মধ্যে অবশ্য আন্তরিকতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার অভাব থাকে না। সৎ প্রতিক্রিয়া হিসেবেই তাদের মধ্যে এটা দেখা যায়।

সাম্প্রদায়িকতা–বিরোধিতার নামে যে বুদ্ধিজীবীদের কথা ওপরে বলা হয়েছে, তাঁরা হলেন একধরনের ‘উচ্চকণ্ঠ অসাম্প্রদায়িক’ গোষ্ঠী। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কোনো আক্রমণের ঘটনা ঘটলেই তাঁরা এর কারণ অনুসন্ধানের মধ্যে না গিয়ে এমন সব বক্তব্য দিতে থাকেন, যা আসল দুষ্কৃতকারীদের চোখের আড়াল করে। এসব আক্রমণ ও হামলার ঘটনা যে শাসকশ্রেণি ও শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, তাদেরই স্থানীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা সংঘটিত—সে বিষয়টি থেকে মানুষের চোখ ফিরিয়ে দিতেই তাঁরা চেষ্টা করেন।

এ উচ্চকণ্ঠ অসাম্প্রদায়িকদের একটি বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। তাঁরা হিন্দু গরিবদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটলেই বলতে থাকেন এবং সম্প্রতি নড়াইলে যে ঘটনা ঘটেছে, তারপরও বলে চলেছেন যে বাংলাদেশ আফগানিস্তান হতে চলেছে! এ ধরনের আজগুবি বক্তব্য যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণকারীদের প্রকৃত চরিত্র আড়াল করারই এক চক্রান্ত, তাতে সন্দেহ নেই।

আফগানিস্তানে সেখানকার শাসকগোষ্ঠী ধর্মীয় উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে যা করছে, তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই। শিয়াদের ওপর যে আক্রমণ হচ্ছে, সেটা করছে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের লোকেরা। তার সঙ্গে আফগানিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই। এ শাসকগোষ্ঠী কট্টর ইসলামি মৌলবাদী। তাদের উদ্দেশ্য ইসলামের নামে দেশে প্রতিক্রিয়াশীল আইনকানুন বলবৎ রাখা, বিশেষ করে নারীদের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের শিক্ষা ও কর্মহীন অবস্থায় গৃহবন্দী করে রাখা।

বাংলাদেশের শাসক দল এ রকম কিছু করছে না। তারা বাংলাদেশে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে শিরোধার্য করে রাখলেও বাস্তবত তারা কোনো ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে না। আফগানিস্তানের তালেবানের মতো তারা নারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আনছে না অথবা তাদের ওপর কোনো আক্রমণ করছে না। নারীরা এখানে অনেকটা পরিমাণে স্বাধীন। তাদের জন্য শিক্ষা ও কাজের দরজা খোলা আছে।

কাজেই বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলা হচ্ছে তাকে যাঁরা তালেবানের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করছেন এবং ‘বাংলাদেশ আফগানিস্তানে পরিণত হতে চলেছে’ বলে আওয়াজ তুলছেন, তাঁরা চরম অজ্ঞ। তাঁরা আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না অথবা দুরভিসন্ধির বশবর্তী হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির তুলনা করছেন। এ উচ্চকণ্ঠ অসাম্প্রদায়িকেরা সবাই শিক্ষিত বলে তাঁরা আফগানিস্তানের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে একেবারে অপরিচিত তা বলা যাবে না।

তাঁরা হিন্দু গরিবদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটলেই বলতে থাকেন এবং সম্প্রতি নড়াইলে যে ঘটনা ঘটেছে, তারপরও বলে চলেছেন যে বাংলাদেশ আফগানিস্তান হতে চলেছে! এ ধরনের আজগুবি বক্তব্য যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণকারীদের প্রকৃত চরিত্র আড়াল করারই এক চক্রান্ত, তাতে সন্দেহ নেই।

ফলে বলতে হয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণকারীদের চরিত্র ও পরিচয় আড়াল করার জন্য তাঁরা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এ কাজ করছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যত জায়গায় এ পর্যন্ত আক্রমণ হয়ে আসছে, দেখা যাবে সেখানে আক্রমণকারীরা স্থানীয় প্রভাবশালী এবং সরকারি দল বা সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্থানীয়ভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি এবং জমি দখল ও লুটপাটের উদ্দেশ্যেই তারা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতি, মন্দির, দোকানপাট ইত্যাদির ওপর আক্রমণ করে।

সম্প্রতি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার সাহাপাড়া গ্রামে ১১টি ঘর, ৫টি মন্দির ও ২০টি দোকান আক্রমণ করে তারা লাখ লাখ টাকা ও সম্পদ লুটপাট করেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে অবশ্য এ সংখ্যা অনেক কম করে দেখানো হয়েছে। এর কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি লক্ষ করার মতো তা হলো বিভিন্ন সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের আক্রমণ হলেও আক্রমণকারীদের ঠিকমতো চিহ্নিত করে তাদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা কোনো সময়েই হয় না।

উপরোক্ত উচ্চকণ্ঠ অসাম্প্রদায়িকেরা এর কারণ সম্পর্কে কিছু বলেন না। সরকার যে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না, তাদের গ্রেপ্তার করা হয় না, ক্ষেত্রবিশেষে গ্রেপ্তার করলেও কয়েক দিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়, শাস্তি দেওয়া হয় না—এসব নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

আগেই বলা হয়েছে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে ধরনের আক্রমণ করা হয়ে থাকে, সে ধরনের আক্রমণ সাঁওতাল, গারো, হাজং এবং চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, উর্দুভাষী মুসলমানদের ওপরেও করা হয়, কিন্তু সেসব আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক বলা হয় না, তা নিয়ে কাউকে তৎপরও হতে দেখা যায় না। এর সহজ কারণ উচ্চকণ্ঠ সাম্প্রদায়িকতা–বিরোধীরা ভারতের দিকে তাকিয়েই হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে।

একই ধরনের আক্রমণ অন্যান্য সংখ্যালঘু এবং অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ক্ষেত্রে ঘটলেও তাঁদের খবর থাকে না। জনগণের ওপর শাসক দল ও সরকারের নানা নির্যাতনের বিরুদ্ধেও তাঁদের সোচ্চার হতে দেখা যায় না। দল বেঁধে তাঁরা এ নিয়ে সংবাদপত্রে কোনো বিবৃতি দেন না, প্রতিবাদ সভা করেন না।

হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণকে সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দিয়ে যেভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে, সেটা যে ভারতের ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির কাছে আদরণীয়, তা বলাই বাহুল্য। যাঁরা এ প্রচারকাজ করেন, তাঁরাও তাদের কাছে আদরণীয়। এসব আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করা হয়ে থাকে যে ভারতে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা আছে, বাংলাদেশেও ঠিক সেভাবেই আছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে ভারতকে বিশেষভাবে দোষী সাব্যস্ত করার কারণ নেই।

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে যেসব আক্রমণের ঘটনা ঘটে এবং সম্প্রতি নড়াইলে যে ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে এত বিস্তারিতভাবে এখানে লেখার কারণ স্পষ্টভাবে দেখানো যে এসব হামলার কোনো প্রকৃত সাম্প্রদায়িক চরিত্র নেই। এ আক্রমণ সব ক্ষেত্রেই ঘটছে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির সঙ্গে সম্পর্কিত লুণ্ঠনজীবীদের দ্বারা, যারা প্রধানত সরকারি দল ও সরকারের সঙ্গে নানা ক্ষেত্রে সম্পর্কিত। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঘটনাগুলো ঘটছে পুলিশের নাকের ডগায়।

পুলিশ সব সময়ই এসব আক্রমণের ফলে ক্ষয়ক্ষতি কম করে দেখানোর চেষ্টা করে, আসল অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে না, গ্রেপ্তার করলেও কয়েক দিনের মধ্যেই ছেড়ে দেয়। কাজেই হিন্দুসহ অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর তারা নির্ভয়ে আক্রমণ করে চলে। অপরাধের শাস্তি নেই বলে দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ পেলেই হিন্দু, সাঁওতাল, চাকমা, উর্দুভাষী মুসলমানদের জমিজমা, ঘরবাড়ি, সম্পত্তি আক্রমণ ও লুটপাট করে।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তান সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ করে তাদের সম্পত্তি লুটপাটের ব্যবস্থা করেছিল। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের ধর্মবিযুক্ত (সেক্যুলার) রাষ্ট্রের সরকার সে আইন বাতিল না করে তার নাম পরিবর্তন করে রেখেছিল ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’। এ আইনের আওতায় তখন থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় লোকেরা দুর্বল হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে তাদের জমিজমা, বাড়িঘর, সম্পত্তি লুটপাট ও দখল করে আসছে। এ লুটপাট থেকে পরবর্তীকালে এবং এখন পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যেভাবে আক্রমণ এবং তাদের সম্পত্তি লুটপাট হচ্ছে, তাকে আলাদাভাবে দেখা অবাস্তব ব্যাপার। ১৯৭২ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও তাদের ওপর আক্রমণ চলছে। এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই।

বদরুদ্দীন উমর বাম প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও গবেষক