প্রায় এক দশক পর ‘পরিকল্পিত’ উদ্যান হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকায় অবস্থিত জাতিসংঘ পার্ক। এ জন্য পার্কের ভেতরে সিটি করপোরেশনের নির্মাণ করা সুইমিংপুল ও জিমনেসিয়াম ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুরো পার্কের অবকাঠামো। মাঠের ভেতরে কেটে সমান করা হচ্ছে উঁচু-নিচু জমি। মাঠের চারপাশে নির্মাণ করা হয়েছে সীমানাপ্রাচীর ও প্রবেশফটক।
প্রায় ২ দশমিক ১৭ একর জায়গাজুড়ে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় অবস্থিত জাতিসংঘ পার্ক। একসময় পার্কের ভেতরে বাগান, জলাশয়, প্রচুর গাছ ও হাঁটার স্থান ছিল। ২০১২ সালে পার্কের ১ একর জায়গায় দুটি সুইমিং পুল ও জিমনেসিয়াম নির্মাণ শুরু করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কাজ শেষ হয় ২০১৫ সালে। প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব স্থাপনা এক দিন ব্যবহারের পরই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। এতে পার্কের জায়গাটি রূপ নিয়েছিল পরিত্যক্ত ভাগাড়ে।
২০২২ সালে এসব স্থাপনা ভেঙে নতুন করে পার্কটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জানা গেছে, প্রায় ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম জেলার পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান উন্নয়ন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর উদ্যানটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
গণপূর্ত অধিদপ্তর জানিয়েছে, নতুন প্রকল্পের আওতায় সীমানাপ্রাচীর, প্রবেশ ফটক, অফিস, দোকান, টিকিট কাউন্টার ও শৌচাগার নির্মাণ করা হবে। ফোয়ারা, হাঁটার পথ ও বসার জন্য আসন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া উদ্যানে আসা শিশুদের জন্য খেলাধুলা ও শরীরচর্চার সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হবে। বর্তমানে প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবেন বলেন আশাবাদী কর্মকর্তারা।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে একপ্রকার পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল পার্কটি। পার্কের এক পাশে সুইমিং পুল ও জিমনেসিয়ামের প্রবেশপথে সব সময় তালা থাকত। আর বাগান ও জলাশয়টি ডোবায় রূপ নিয়েছিল। হাঁটার পথে বর্ষায় ৩-৪ ফুট পানি থাকত। তাই এখানে আর কোনো দর্শনার্থী আসত না।
নতুন করে পার্ক নির্মাণের পর তাতে টিকিট কাউন্টার রাখা হবে। তবে শুরুতে পার্কটি উন্মুক্ত থাকবে সবার জন্য। ভবিষ্যতের কথা ভেবে টিকিট কাউন্টার করা হচ্ছে। উদ্যানে হাঁটতে ও ঘুরতে আসা মানুষদের জন্য একটি দোকান থাকবে। উদ্যানটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ছোট অফিস করা হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পার্কের ভেতরে এখন হাঁটার পথ, স্থাপনা ও ফোয়ারার কাজ চলছে। উদ্যানের ঠিক মধ্যখানে রয়েছে ফোয়ারাটি। এর চারপাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে হাঁটার পথ। উদ্যানে বসার স্থান নির্মাণ এখনো শেষ হয়নি। সীমানাপ্রাচীর ও প্রবেশ ফটক নির্মাণ প্রায় শেষ। এ ছাড়া বাকি রয়েছে উদ্যানে আলোকসজ্জার কাজ।
জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের (সার্কেল-১) নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, উদ্যানের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে ওয়াকওয়ের কাজ চলছে। আলোকসজ্জার কাজ এখনো শুরু হয়নি। আশা করা যাচ্ছে জুন-জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে।
পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ বাবু আহমেদ বলেন, একসময়ের দৃষ্টিনন্দন পার্কটি ময়লা-আবর্জনায় পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রায় এক দশক পর পাঁচলাইশ এলাকাবাসী পার্কটি পেতে যাচ্ছে। এটা তাদের জন্য স্বস্তির খবর।
জাতিসংঘ পার্কে উন্নয়নকাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে। এর আগে পার্কের ভেতরে থাকা সুইমিং পুল ও জিমনেসিয়াম ভেঙে ফেলা হয়। দুটি সুইমিং পুলের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ছিল ১২০ ফুট, প্রস্থ ৫০ ফুট। একটির গভীরতা ৮ ফুট, আরেকটির সাড়ে ৮ ফুট। জিমনেসিয়াম ভবনটি ৭ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর ছিল। তবে তাতে শরীরচর্চার কোনো সরঞ্জাম ছিল না।
২০১৫ সালের জুনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকায় নির্মিত স্থাপনাগুলো সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। ২০১৬ সালে পার্কের মালিকানা নিয়ে গণপূর্তের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের বিরোধ দেখা দেয়। সে বছর করপোরেশন উদ্যান, জিমনেসিয়াম ও সুইমিং পুল বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২৫ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বাণিজ্যিকভাবে পার্ক ইজারা দেওয়ার উদ্যোগের প্রতিবাদ জানায় গণপূর্ত অধিদপ্তর।
এরপর পার্কের উন্নয়নে সিটি করপোরেশন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর পৃথকভাবে উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণ না করায় উদ্যানটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। পরে একপ্রকার পরিত্যক্ত হয়ে যায় দৃষ্টিনন্দন উদ্যানটি। প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা এই স্থাপনা কোনো কাজেই আসেনি। এরপর ২০২২ সালে স্থাপনাগুলো ভেঙে নতুন করে উদ্যানটি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। স্থানীয় লোকজন বলছেন, পরিকল্পনা ছাড়াই এগুলো নির্মাণ হয়েছিল। ফলে আবাসিকের বাসিন্দাদের কোনো কল্যাণে আসেনি এগুলো।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া কোনো ধরনের উন্নয়ন টেকসই হয় না। যে টাকা অপচয় হলো, তা জনগণের রাজস্বের টাকা। তাই কোনো উদ্যোগ হাতে নেওয়ার আগে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করেই পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।
নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে যেভাবে উদ্যানকে সাজানো হচ্ছে, সেটি যাতে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন নগর-পরিকল্পনাবিদ মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি বলেন, এই উদ্যান নিয়ে যাতে দুই সংস্থার মধ্যে আর কোনো সমন্বয়হীনতা না থাকে। আর উদ্যানটি যেন সব সময় ব্যবহারের উপযোগী থাকে।