আমদানি–রপ্তানি ও দেশে উৎপাদিত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা যৎসামান্য। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ কম। জনবলেও ঘাটতি।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) আদলে দেশে খাদ্য নিরাপদ করার লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। সংশ্লিষ্ট দেশি–বিদেশি সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমদানি, রপ্তানি ও দেশে উৎপাদিত খাদ্য নিরাপদ করার কাজ তাদের। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৯ বছর পরও সেই উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি বিএফএসএ। ফলে দেশবাসীর মুখে নিরাপদ খাদ্য তুলে দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না তারা।
দেশে সম্প্রতি পরিচালিত গবেষণায় সয়াবিন তেল, ডিমসহ নানা খাদ্যে ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নানাভাবে খাবার দূষিত হচ্ছে। ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে নানা জটিলতায় ভুগছে। আর্থিক, সামাজিকসহ নানা ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছে। মৃত্যুও যাচ্ছে।
বিএফএসএ বলছে, খাবার নিরাপদ করার চেষ্টা চলছে। নিরাপদ না হলে সে খাবার ধ্বংস করা হবে।
সবার সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে, নইলে কাজ করতে পারব না—এমন কোনো কথা নেই।’ তবে অর্পিত দায়িত্ব যে কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি পালন করতে পারছে না, সেটা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজের পরিধি বাড়ছে। কিন্তু আমরা এখনো সোল অথরিটি (একমাত্র কর্তৃপক্ষ) হতে পারিনি। সময় দিতে হবে।বিএফএসএর পরিচালক (খাদ্য পরীক্ষাগার নেটওয়ার্ক সমন্বয়) সহদেব চন্দ্র সাহা
যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্টের বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচক ২০২২ অনুযায়ী, গুণমান ও নিরাপদ বিবেচনায় বিশ্বের ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার (৬৫তম) ও ভারতের (৬৭তম) চেয়েও বাংলাদেশের খাদ্য বেশি অনিরাপদ।
এ অবস্থায় আজ শুক্রবার দেশে ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস’ পালিত হচ্ছে।
দেশে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএফএসএ গঠন করা হয়। আইনে বলা হয়েছে, ‘খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয়–সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ’ করবে বিএফএসএ।
জানা গেছে, নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ১৮টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের ৪৮৬টির বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খাদ্যনিরাপত্তায় ভূমিকা রাখে—এমন আরও অসংখ্য দেশি–বিদেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত মাত্র সাতটি সরকারি, চারটি বেসরকারি ও চারটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ।
বিএফএসএর পরিচালক (খাদ্য পরীক্ষাগার নেটওয়ার্ক সমন্বয়) সহদেব চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে, নইলে কাজ করতে পারব না—এমন কোনো কথা নেই।’ তবে অর্পিত দায়িত্ব যে কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি পালন করতে পারছে না, সেটা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজের পরিধি বাড়ছে। কিন্তু আমরা এখনো সোল অথরিটি (একমাত্র কর্তৃপক্ষ) হতে পারিনি। সময় দিতে হবে।’
অথচ বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি পণ্য নিয়ন্ত্রণে কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারছে না বিএফএসএ। দেশে যেসব খাদ্য ও খাদ্য উপাদান আমদানি হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে না সংস্থাটি।
মার্কিন সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের তথ্য তুলে ধরতে সে দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের তৈরি প্ল্যাটফর্ম শেয়ারআমেরিকার তথ্যমতে, এফডিএ যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত সব খাদ্য নিরাপদ করার বিষয়টি নিশ্চিত করে। এই প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য সরবরাহের ৭৮ শতাংশের মান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
অথচ বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি পণ্য নিয়ন্ত্রণে কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারছে না বিএফএসএ। দেশে যেসব খাদ্য ও খাদ্য উপাদান আমদানি হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে না সংস্থাটি।
অবশ্য বিএফএসএ দাবি করছে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয় সভায় আমদানির সব পণ্যের গুণগত মান ও নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টি আলোচনা হয়। সভায় আমদানির পণ্য নিরাপদ করতে প্রবিধান করার বিষয়টি ওঠে।
বাংলাদেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এটি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে (বিএফএসএ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন) আনা কঠিন। আবার খাদ্যদ্রব্যের মাননিয়ন্ত্রক বিএসটিআই শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি–রপ্তানির বিষয়টি দেখে। এসব নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে বিএফএসএ অনেকটা কার্যকর হবে। জটিলতা নিরসনে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
পরিচালক সহদেব চন্দ্র সাহা বলেন, ‘প্রবিধান হলে কাজটি আমাদের জন্য সহজ হবে। তখন দেশে আমদানি করা কোনো পণ্য এলে আমরা নমুনা পরীক্ষা করে জানাতে পারব, এটি স্বাস্থ্যকর কি না। স্বাস্থ্যকর হলে আসবে, নইলে আসবে না।’
পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই প্রতিষ্ঠানটির। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিবর্তে খাদ্যপণ্য রপ্তানির স্বাস্থ্যসনদ দেওয়ার দায়িত্ব বিএফএসএকে দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য খাদ্যপণ্য রপ্তানি হলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে তারা মাত্র ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ১৪টি খাদ্যপণ্য রপ্তানির স্বাস্থ্যসনদ দিয়েছে।
জানা গেছে, নমুনা পরীক্ষার জন্য বিএফএসএর নিজস্ব কোনো পরীক্ষাগার নেই।
বিএফএসএর সাবেক সদস্য এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগের অধ্যাপক মো.আবদুল আলীম প্রথম আলোকে বলেন, মার্কিন এফডিএ খাদ্য ও ওষুধ—দুটিই নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এটি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে (বিএফএসএ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন) আনা কঠিন। আবার খাদ্যদ্রব্যের মাননিয়ন্ত্রক বিএসটিআই শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি–রপ্তানির বিষয়টি দেখে। এসব নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে বিএফএসএ অনেকটা কার্যকর হবে। জটিলতা নিরসনে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
গ্রেড দেখে ভোক্তারা যেন রেস্তোরাঁর খাবারে মান কেমন, তা বুঝতে পারেন। গত পাঁচ বছরে সারা দেশে মাত্র ৩০৬টি রেস্তোরাঁকে গ্রেড দেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে চেয়ারম্যান, সদস্য, সচিব, পরিচালক, নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা, মনিটরিং কর্মকর্তা, গবেষণা কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, খাদ্য বিশ্লেষক, আইন কর্মকর্তা, পরিসংখ্যান কর্মকর্তাসহ মোট ১৯টি পদ রয়েছে। গত অর্থবছরের তথ্যমতে, এসব পদে ৩০৯ জন কর্মরত আছেন।
রাজধানীর শাহবাগে বিএসএল কমপ্লেক্সে বিএফএসএর প্রধান কার্যালয়। এ ছাড়া সব বিভাগীয় শহরে মেট্রোপলিটন কার্যালয় রয়েছে। প্রতিটি কার্যালয়ে একজন করে আটজন নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা রয়েছেন। রয়েছে জেলা কার্যালয়। সেখানে একজন কর্মকর্তা এবং এক বা একাধিক কর্মচারী রয়েছেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, এত অল্প জনবল দিয়ে পুরো জেলার খাদ্য নিরাপদ করার তদারকি বাস্তবসম্মত নয়।
দেশে হোটেল–রেস্তোরাঁর খাবার কতটা নিরাপদ, তার ভিত্তিতে চার ধরনের গ্রেড দেয় বিএফএসএ। খাবার মান খুব ভালো হলে ‘এ প্লাস’, ভালো হলে ‘এ’, গড়পড়তা হলে ‘বি’ এবং গড়পড়তার নিচে গেলে ‘সি’ অথবা গ্রেড দেওয়া হয় না। এর উদ্দেশ্য—গ্রেড দেখে ভোক্তারা যেন রেস্তোরাঁর খাবারে মান কেমন, তা বুঝতে পারেন। গত পাঁচ বছরে সারা দেশে মাত্র ৩০৬টি রেস্তোরাঁকে গ্রেড দেওয়া হয়েছে।
অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত হোটেল ও রেস্টুরেন্ট সার্ভে-২০২১ অনুযায়ী, দেশে হোটেল–রেস্তোরাঁর সংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার।
বিএফএসএ ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করে থাকে। খাদ্যে ভেজাল বা অনিয়ম পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জেল-জরিমানা করে। ২০২২–২৩ অর্থবছর ১৬৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ১৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জরিমানা করেছে তারা।
অথচ এই একই ধরনের কাজ করে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএফএসএ যা কিছু কাজ করছে, তা খুবই অপর্যাপ্ত ও পুনরাবৃত্তি।
বিএফএসএ বাজার, রেস্তোরাঁ, খাদ্য কারখানা ইত্যাদি পরিদর্শন করে। খাদ্য কীভাবে উৎপাদিত হচ্ছে, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে উৎপাদিত হচ্ছে কি না, যথাযথ পুষ্টিমান আছে কি না, স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে কি না—পরিদর্শনকালে এসব দেখা হয়। এর মাধ্যমে কারখানাগুলোতে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশনে উৎসাহিত করা হয়। কয়েকবার সতর্ক করা হয়। তবু কেউ না মানলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ হাজার ৫৬৪টি খাদ্য স্থাপনা পরিদর্শন করে বিএফএসএর দল। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৭৫৪টি।
পরিদর্শন বাড়লেও নমুনা সংগ্রহ কমেছে। মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্যের নমুনা সংগ্রহ করে তা নিরাপদ কি না দেখা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৮২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১৫২টি নমুনায় অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি বিভিন্ন পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে নমুনা পরীক্ষা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭০টি। এর মধ্যে ৯১টিতে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বিভিন্ন পদার্থের উপস্থিতি বেশি পাওয়া যায়।
শেয়ারআমেরিকার তথ্যমতে, অনিরাপদ খাদ্য থেকে দুই শর বেশি অসুখ হতে পারে। এতে উৎপাদনের ক্ষতি ও চিকিৎসা ব্যয় বাবদ সারা বিশ্বে বছরে ১১ হাজার কোটি ডলারের বেশি ক্ষতি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিশ্বে প্রতিবছর খাদ্যবাহিত রোগে ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, মানুষের মুখে নিরাপদ খাদ্য তুলে দিতে বিএফএসএকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যকর করতে হলে সরকারি সিদ্ধান্ত দরকার বলে মনে করেন সংস্থাটির সাবেক সদস্য আবদুল আলীম।