‘বাংলাদেশের ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউ (ভিএনআর) ও নাগরিক অংশগ্রহণ’ শিরোনামে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত জাতীয় সংলাপে বক্তারা। আজ রাজধানীর তেজগাঁও লিংক রোডে আলোকি কনভেনশন সেন্টারে
‘বাংলাদেশের ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউ (ভিএনআর) ও নাগরিক অংশগ্রহণ’ শিরোনামে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত জাতীয় সংলাপে বক্তারা। আজ রাজধানীর তেজগাঁও লিংক রোডে আলোকি কনভেনশন সেন্টারে

দেশে এখন আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার জন্ম হয়েছে

দেশ এখন বিরাট সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার জন্ম হয়েছে। এই সময়ে প্রান্তিক মানুষের কথা তুলে এনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে কতটুকু অগ্রগতি, ঘাটতি ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা তুলে ধরতে হবে বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে। জাতীয় সমীক্ষার মাধ্যমে তথ্য–উপাত্তের ঘাটতি ও বিকৃতি পূরণ করতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আজ রোববার ‘বাংলাদেশের ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউ (ভিএনআর) ও নাগরিক অংশগ্রহণ’ শিরোনামে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এক জাতীয় সংলাপে এসব কথা বলেন বক্তারা।

এসডিজি বাস্তবায়নে ভিএনআর প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে রাজধানীর তেজগাঁও লিংক রোডে আলোকি কনভেনশন সেন্টারে এই সংলাপের আয়োজন করা হয়। ভিএনআর প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের কাছে উপস্থাপনের লক্ষ্যে আয়োজিত সভায় মতামত দেন নানা স্তরের ৫২ জন ব্যক্তি। তাঁরা বলেন, বিগত সরকারের সময় ভিএনআর প্রতিবেদনে যেসব উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছিল, তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল ছিল না। এবার প্রতিবেদনে জেন্ডার অসমতা, সহিংতা, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন, প্রান্তিক মানুষের কথা, তরুণদের শোভন কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংকট, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে ঘাটতির বিষয় যথাযথ তথ্য উঠে আসতে হবে।

২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে কোন ধরনের অভিজ্ঞতা হলো, কী সফলতা এল, কী চ্যালেঞ্জ আছে, তা তুলে ধরে এসডিজি বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ভিএনআর প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে জাতিসংঘের হাই লেভেল পলিটিক্যাল ফোরাম বা এইচএলপিএফে (উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক ফোরাম) দেশগুলো প্রতিবেদন তুলে ধরে জানায় এসডিজি বাস্তবায়নের চিত্র। ২০১৭ ও ২০২০ সালের পর ২০২৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের তৃতীয় ভিএনআর প্রতিবেদন তুলে ধরার কথা রয়েছে।

সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ বলেন, প্রতিষ্ঠান, উপাত্ত ও পরিসংখ্যানগত সক্ষমতায় দুর্বলতা থাকায় এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে উন্নয়নের গতিপথে বাস্তব তথ্য তুলে আনা হয়নি। এ সরকার সত্যিকারের তথ্য তুলে আনার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে কাজ করছে। ভিএনআরএর প্রস্তুতিমূলক এই আলোচনা বিগত বছরগুলোর চর্চা ভেঙে এসডিজি অর্জনে নতুন যাত্রা শুরু করতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, ‘যখন আমরা পর্যালোচনার পর প্রতিবেদন জমা দেব, তখন আমাদের হাতে একটি জাতীয় প্রতিবেদন থাকা উচিত, যেখানে এসডিজি অর্জনের অগ্রগতির পথে সরকারি ও বেসরকারি সব পর্যায়ের অবদান উঠে আসবে।’

নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। তিনি জাতীয় সমীক্ষার মাধ্যমে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি পূরণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই সমীক্ষা শুধু সরকারি যেন না হয়। বৃহত্তর পরিসরে নতুন বাস্তবতায় সরকারের সামনেও সুযোগ এসেছে তারা কীভাবে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কের মূল্যায়ন করবে। সেখানে ব্যক্তিখাত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাটা পরিষ্কারভাবে আসবে। এটা একটা সুযোগ। তিনি বলেন, ‘নতুন পরিপ্রেক্ষিতে এই ভিএনআর প্রতিবেদন তৈরিকে টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার ভালো সূচনা হিসেবেই আমরা দেখতে চাই।’

সংলাপে ‘বাংলাদেশে এসডিজির অগ্রগতির বিষয়ে নাগরিকদের পর্যালোচনা: জাতীয় ভিএনআর প্রক্রিয়ায় অবদান’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

সংলাপে বক্তা হিসেবে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন একটি আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার জন্ম হয়েছে। সাঈদ, মুগ্ধদের হারানোর পাশাপাশি তরুণ একটি প্রজন্মকে জেনেছে দেশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বড় দাবি ছিল শোভন কর্মসংস্থান। এই দাবিকে মাথায় রেখে কীভাবে তরুণদের ভালো ভবিষ্যৎ গড়া যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। বৈশ্বিকভাবে এসডিজি অর্জন হয়েছে ১৯ শতাংশ। দেশে অর্জন কতখানি, সে তথ্য নেই। ভিএনআর প্রতিবেদনে সরকারি ভাষ্যের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের আখ্যানও নিয়ে যেতে হবে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, বাংলাদেশের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পেলেও দেশে পায় না। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চা–বাগানের মানুষ, যাঁদের পিছিয়ে রাখা হয় এবং শিক্ষা নিয়ে এগোতে থাকা মেয়েরা বাল্যবিবাহের মাধ্যমে যেভাবে পিছিয়ে যায়, সেসব তথ্য আনতে হবে।

আরেক বক্তা নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, প্রান্তিক মানুষের শুধু নির্যাতন-বঞ্চনার কথা তুলে আনলে হবে না। তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ দিতে মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ এখন বিরাট সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মধ্যে আশা জেগেছে। একসঙ্গে কাজ করলে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।

নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও সাবেক ভাইস চেয়ারপারসন আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী এসডিজি অর্জনে স্বাস্থ্য খাতে মনোযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখে ৭০–এ নামিয়ে আনতে হবে। এ হার এখনো অনেক বেশি। সরকারি প্রতিবেদনগুলোর একেকটিতে এ হার একেক রকম বলা হচ্ছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমানো না গেলে এসডিজি অর্জন কঠিন হবে। আর সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিগত সরকার শুধু কথাই বলেছে।

এসডিজি বাস্তবায়নে ভিএনআর প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে আয়োজিত সংলাপে বক্তৃতা করছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আজ রাজধানীর তেজগাঁও লিংক রোডে আলোকি কনভেনশন সেন্টারে

জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বলেন, এসডিজি অর্জনে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এখানে উপাত্ত ঘাটতির বিষয়টিকে শনাক্ত করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের তুলে ধরার সময় এখন বাংলাদেশের। জাতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রান্তিক মানুষের কথা তুলে আনতে হবে।

এ সময় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত ১৫ বছরে দলীয় সরকার এনজিওদের ওপর নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রকল্পের অনুমোদন, নিবন্ধন ও নবায়নে এনজিও ব্যুরো, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে যুক্ত করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এ নিয়ে অসন্তোষ বিদ্যমান। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এনজিওকে তথ্যভিত্তিক স্বীকৃতি দিতে হবে। সরকারি তথ্যের ঘাটতি থাকলে বেসরকারি যেসব তথ্য গ্রহণযোগ্য, সেসব যেন ব্যবহার করা হয়।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন ২০০৯ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত এক সভায় তৎকালীন সরকারের প্রতিনিধি ও দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ছিলেন জানিয়ে বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ থাকা নিয়ে ওই সময় বলা হয়েছিল, ‘এ সরকার এর জন্য দায়ী নয়।’ এবার ভিএনআর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় আগের সরকারের কাজের জন্য দায়ী না বলে অন্তর্বর্তী সরকার যেন দায়িত্ব না এড়ায়।

এ প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, আগের সরকারের কাজের দায়িত্ব যদি না নেওয়া হয়, তবে তা কেন নেওয়া হয়নি, সে ব্যাখ্যা থাকতে হবে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা, গণতন্ত্রহীনতার জন্য পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা কেন নেই, সে ব্যাখ্যা থাকতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বিভিন্ন দেশে মানব পাচার বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইন ও বৈষম্যবিরোধী আইন বাস্তবায়নে জোর দেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কাজ বিস্তৃত করার পরামর্শ দেন। মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনা প্রভাবমুক্ত করার দাবি জানান।

বন্ধু ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান বলেন, হিজড়া ও রূপান্তরিত ব্যক্তিদের অবস্থা এখন আরও খারাপ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি উন্নয়নে তিনি সরকারের সহায়তা চান।

বেসরকারি সংস্থা এডিডির সমন্বয়ক লিটন বাড়ৈ বলেন, ভিআরএন প্রতিবেদনে বর্তমানের চ্যালেঞ্জ তুলে আনা উচিত। শিক্ষার্থী–জনতার অভ্যুত্থানে অনেক মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন। তাঁদের বিষয়গুলো আনা দরকার।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডোর দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহারের কথাটিও ভিএনআর প্রতিবেদনে থাকা দরকার। সিডোর ২ ধারায় পারিবারিক আইনসহ সব আইনে নারী-পুরুষের সমতা আনা এবং ১৬ (১) (গ) ধারায় বিবাহ এবং এর বিচ্ছেদে সম–অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সর্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বৈষম্য দূর করার সুপারিশ করেন তিনি।

সর্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়নের বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলো যে নির্বাচনী ইশতেহারে রাখে, সে লক্ষ্য উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

সংলাপে বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট (জিআইইউ) মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল লতিফ, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. সাইদুর রহমান।