ইউএনডিপির উদ্যোগে ও ডেইলি স্টারের সহায়তায় জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অতিথিরা আজ বুধবার রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে
ইউএনডিপির উদ্যোগে ও ডেইলি স্টারের সহায়তায় জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অতিথিরা আজ বুধবার রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে

জনপ্রশাসন নিয়ে গোলটেবিল

রাজনীতি ঠিক না হলে আমলাতন্ত্র ঠিক হবে না

প্রশাসনযন্ত্রকে প্রচণ্ড রকমভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে। এটিকে ক্রমেই দলীয় স্বার্থ রক্ষার একটি মাধ্যম হিসেবে রূপান্তর করা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রকে শক্তভাবে দাঁড়ানোর জন্য আমলাতন্ত্রকে শক্তভাবে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু রাজনীতি ও সরকার দুর্বল ছিল বলে আমলাতন্ত্রকে পদাবনত করে রাখার প্রবণতা দেখা গেছে। তাই আমলাতন্ত্রকে পেশাদারির সঙ্গে শক্তভাবে দাঁড়ানোর জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। রাজনীতি ঠিক না হলে আমলাতন্ত্র বা প্রশাসনযন্ত্র কখনো ঠিক হবে না।

আজ বুধবার রাজধানীর ডেইলি স্টার সেন্টারে জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথাগুলো বলেন জনপ্রশাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ইউএনডিপি আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকের সহায়তায় ছিল ডেইলি স্টার। ‘ট্রান্সফর্মিং বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন: ওভারকামিং চ্যালেঞ্জ অ্যান্ড শেপিং রিফর্মস’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও স্থানীয় সরকার কমিশনের সদস্য, সচিবসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বক্তব্য দেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, সমস্যাগুলোর একটি চেহারা পরিষ্কার। জবাবদিহিবিহীন সরকারি প্রশাসনযন্ত্র, যেটি ক্রমেই একটি ফ্যাসিস্ট শাসনামল সৃষ্টি করে, সে রকম একটি প্রশাসনযন্ত্র কীভাবে বাংলাদেশে এত দিন ছিল, কীভাবে তার চর্চাগুলো করেছে, তার কারণ ১০ দিনে বা ১০ বছরে তৈরি হয়নি। এটি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে। এই সংকটগুলো অচেনা নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিভিল সার্ভিসে যাঁরা মেধার ভিত্তিতে যুক্ত হন, সেই প্রশাসনযন্ত্রকে ক্রমেই দলীয় স্বার্থ রক্ষার একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে রূপান্তর করা হয়েছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব রিজওয়ান খায়ের বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে জনপ্রশাসনে সংস্কার করতে হবে। এখনই তা শুরু করতে হবে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য খোন্দকার মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বলেন, এর আগে এ বিষয়ে ১৭টি কমিশন বা কমিটি হয়েছে; কিন্তু কাজ হয়নি। এখন তাঁরা চেষ্টা করছেন তাঁদের বিষয়গুলোও (সংস্কার কমিশনের সুপারিশ) যেন একই পর্যায়ে না যায়। বর্তমান সরকার জবাবদিহিমূলক সরকার। তাই তাঁরা আশা করছেন, আমলাতন্ত্রকে জনমুখী করতে তাঁদের সুপারিশ যদি উপযুক্ত মনে হয়, তাহলে সরকার তা গ্রহণ করবে।

‘আমলাতন্ত্র একটি ঘোড়ার মতো’

বিসিএস প্রশাসন একাডেমির রেক্টর ও সরকারের সচিব ওমর ফারুক বলেন, আমলাদের নানাভাবে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু আমলাদের ভেতর থেকে দেখার মানসিকতা বা এ ধরনের প্রয়াস খুব কমই আছে। এ রকম একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা দেখার মানসিকতা থাকতে হবে। আমলারা কতটুকু দায়ী, সেটিও পরিমাপের বিষয় আছে।

‘আমলাতন্ত্রের ঘোড়া’ নামের একটি বইয়ের প্রসঙ্গ টেনে ওমর ফারুক বলেন, ‘আসলে আমলাতন্ত্র একটি ঘোড়ার মতো। আমরা (আমলাতন্ত্র) যদি ঘোড়া হই, রাজনীতিবিদেরা সেটির ওপর সওয়ার। সুতরাং রাজনীতিবিদেরা যেদিকে যাবেন, আমি আরেক দিকে যেতে পারব না।’ রাজনীতি ঠিক না হলে আমলাতন্ত্র বা প্রশাসনযন্ত্র ঠিক হবে না বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ফেরদৌস আরফিনা ওসমান প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমরা জনপ্রশাসনকে শুধু সেবা প্রদানের হাতিয়ার হিসেবে দেখতে চাই, নাকি রাষ্ট্র তৈরির একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখতে চাই? তিনি বলেন, ‘যদি আমরা পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকাই—হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি জাপান—এই দেশগুলো একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উন্নত অবস্থায় এসেছে, আমলাতন্ত্রকে একটি শক্ত জায়গায় অবস্থান দিয়ে। আমরা স্বাধীনতার পর থেকে আমলাতন্ত্রকে ওইভাবে চিন্তা করিনি।’

অধ্যাপক ফেরদৌস আরফিনা বলেন, আসলে গণতন্ত্রের সঙ্গে আমলাতন্ত্রকে কখনো সংযোগ করা হয়নি। গণতন্ত্র সব সময় ভঙ্গুর। রাজনীতি ছিল দুর্বল, সরকার দুর্বল, সে কারণে সব সময় একটা ফোকাস ছিল কীভাবে আমলাতন্ত্রকে পদাবনত করে রাখা যায়। আমলাতন্ত্রও তার প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ, তার নিজস্ব মর্যাদা নিয়ে কখনো শক্তভাবে দাঁড়ায়নি।

আলোচনার সারসংক্ষেপ করতে গিয়ে ইউএনডিপির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক বলেন, আলোচনায় একটি বিষয় বারবার এসেছে, সেটি হলো গণতান্ত্রিক একটি ব্যবস্থা এবং সেই ব্যবস্থায় জনপ্রশাসন কেমন হবে? এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ডেইলি স্টারের এনজিও এবং বিদেশি মিশন ইনচার্জ তানজিম ফেরদৌসের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শায়ান, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আজহার উদ্দিন, বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক মো. আবু জাফর রিপন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি মার্গা পিটারস, ব্রিটিশ হাইকমিশনের প্রতিনিধি নেইল গান্ধী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কৃষ্ণ কুমার সাহা, ইনটেলিয়ন টেকব্রিজের ব্যবসায় উন্নয়ন প্রধান কামরুল ইসলাম খান, ইউএনডিপি বাংলাদেশ অফিসের সিনিয়র গভর্ন্যান্স অ্যাডভাইজার নাজিয়া হাশমি, ব্র্যাকের মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইশা ফারাহ।