বাপেক্সকে দুর্বল রেখে বিদেশি কোম্পানির দিকে ঝোঁক

বাপেক্সের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বাধা দেখছেন বিশেষজ্ঞর।সফলতার হার বেশি হলেও কূপ খননে পিছিয়ে। 

বাপেক্স আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র ভোলার ইলিশা-১
বাপেক্স আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র ভোলার ইলিশা-১

সিলেটের জকিগঞ্জে ২০২১ সালের আগস্টে দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে সংস্থাটির খরচ হয় ৭৮ কোটি টাকা। আর ভোক্তাপর্যায়ে গ্যাসের গড় দাম বিবেচনায় মজুত গ্যাসের দাম আড়াই হাজার কোটি টাকা।

এ বছরের মে মাসে ভোলায় ২৯তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থার খরচ হয়েছে ১৯০ কোটি টাকা। যদিও জকিগঞ্জে বাপেক্স নিজে কূপ খনন করে খরচ করেছে ৭৫ কোটি টাকা। আর ভোলায় কূপ খননে বিদেশি কোম্পানি গাজপ্রমকে দিতে হয়েছে ১৮০ কোটি টাকার বেশি। এ গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া গেছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার গ্যাস। গত ৯ মাসে ভোলায় মোট তিনটি কূপে গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে বাপেক্স।

স্বল্প বিনিয়োগে নিয়মিত ব্যবধানে এমন সাফল্য দেখাচ্ছে বাপেক্স। সর্বশেষ তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের একটি পরিত্যক্ত কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদনের সফলতা দেখিয়েছে তারা। গত ৯ জুন এ কূপ থেকে দিনে ৮০ লাখ ঘনফুট করে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে।

বিশ্বের যেকোনো দেশের কোম্পানির তুলনায় বাপেক্সের গড় সাফল্য বেশি। যদিও দেশে বাপেক্সের সক্ষমতা নিয়ে কয়েক দশক ধরেই বিতর্ক চলছে। কিন্তু কোনো সরকারই রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর তেমন নজর দেয়নি। অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় রিগ (খননযন্ত্র) ও জনবল বাড়ানো হচ্ছে না। এক দশক ধরে সরকারের কোনো অর্থায়নও নেই; বরং বাপেক্সকে দুর্বল করে রেখে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানের ঝোঁক বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের সংকটে জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে দেশে। জ্বালানির আমদানিনির্ভরতার কারণেই এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকেছে সরকার। ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। আমদানি আরও বাড়াতে নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। অথচ বাপেক্সকে শক্তিশালী করা গেলে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান জোর পেত। বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হতো না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা সহজ, করাটা অত সহজ নয়। এর জন্য প্রচুর বিনিয়োগ দরকার, দক্ষ জনবল ও ভালো বেতন দিতে হবে। শুধু দেশের ভেতরে কাজ করে এত বড় বিনিয়োগ উঠে আসবে না। বিদেশে কাজ করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কোনো সরকার বাপেক্সকে ওই রকম বড় কোম্পানি বানানোর চিন্তা করেনি, বড় বিনিয়োগও করেনি। বাপেক্স নিজেও খুব ভালো কোনো পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের কাছে যায়নি। তারা সাহস দেখায় না। বাপেক্সের সীমাবদ্ধতার কারণেই বিদেশি কোম্পানি দেশে আনতে হয় বলে তিনি মনে করেন।

নতুন কর্মী নিয়োগ হলে বাপেক্সের কাজের সক্ষমতা বাড়বে। এর সঙ্গে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আর বিনিয়োগ যুক্ত হলে বিশ্বমানের গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি হতে পারে বাপেক্স। এ সংস্থাকে পাঁচটি খননযন্ত্র দেওয়া হলে বছরে ১৫টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা যাবে।
বাপেক্সের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী

গত দুই দশকে বৈশ্বিক কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পেট্রোনাস ও ভারতের অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি)। একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে বাপেক্সের যা খরচ হয়, তার প্রায় তিন গুণ নিচ্ছে রাশিয়ার কোম্পানি গাজপ্রম। এখন পর্যন্ত ২০টি কূপের কাজ দেওয়া হয়েছে গাজপ্রমকে। আরও কূপ খননের কাজ পেতে পারে এ বিদেশি সংস্থা। এ ছাড়া স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সের একক এখতিয়ার আর থাকছে না।

সমুদ্রের পাশাপাশি স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ দিতে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে সরকার।

বাপেক্স জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীন একটি কোম্পানি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলছে, বাপেক্স কোম্পানি হিসেবে নিজস্ব সিদ্ধান্তে চলবে। কিন্তু নিজেদের বড় প্রতিষ্ঠান করার কোনো পরিকল্পনা নেই সংস্থাটির। দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে তিন বছরে ৪৬টি কূপ খনন করা হচ্ছে। এটি বাপেক্স একা করলে ১০ বছরের বেশি লেগে যাবে। কিন্তু গ্যাস তো দরকার এখন। এ ছাড়া বাপেক্সের ভেতরেও একটা চক্র আছে, যারা সংস্থাটিকে পিছিয়ে রাখছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০০ কোটি টাকা খরচ করলে অন্তত ছয় হাজার কোটি টাকার গ্যাস পাওয়া যায়, এমন প্রকল্পে সরকার তো বিনিয়োগ করতে চায়। বাপেক্সকে নেতৃত্ব দিতে হবে। সংস্থাটিকে শক্তিশালী করতে তাদেরই চাইতে হবে, পেশাদারত্ব বাড়াতে হবে। জরুরি গ্যাস দরকার এখন, এ কারণে বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজের গতি বাড়ানো হয়েছে। মাঝে বাপেক্সের কাজ মন্থর হলেও গত তিন বছরে গতি আনা হয়েছে।

যদিও বাপেক্স মনে করে, নিজস্ব বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ঘাটতি, দক্ষ জনবলের অভাবকে সঙ্গী করেই তাদের এগোতে হচ্ছে।

অনুসন্ধানের খননযন্ত্র মাত্র দুটি

গ্যাসক্ষেত্র আছে, এমন দেশগুলোতে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বছরে পাঁচ থেকে সাতটি কূপ খননের কথা। বছরে অন্তত তিনটি কূপ খননের সক্ষমতা আছে বাপেক্সের। অথচ বাংলাদেশে খনন করা হয়েছে গড়ে একটি অনুসন্ধান কূপ। দেশের স্থলভাগে একটি কূপ খননে বাপেক্স সর্বোচ্চ খরচ করে ৮০ কোটি টাকা। আর বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে এখন একটি কূপে খরচ হচ্ছে ১৮০ কোটি টাকার বেশি।

বাপেক্স সূত্র বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুটি অনুসন্ধান কূপ খনন ও দুটি ওয়ার্কওভার (কূপে একধরনের সংস্কার) মিলে চারটি খননযন্ত্র কিনে দেয় সরকার। এর মধ্যে সর্বশেষ অনুসন্ধান খননযন্ত্রটি কেনা হয়েছে ২০১২ সালে। এখন কোম্পানির মোট খননযন্ত্র আছে ছয়টি।

কোনো কূপে গ্যাস না পেলে তা ব্যর্থতা নয়। টাকা গচ্চা যাওয়া বলা যাবে না। কোনো কূপে গ্যাস না পেলেও সেখানকার তথ্য পাওয়া যাবে। গ্যাস না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হলে ওই এলাকা তখন অন্য কাজে লাগানো যাবে।
বাপেক্স বোর্ডের সদস্য ভূতত্ত্ববিদ মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া

এর মধ্যে অনুসন্ধান কূপ খনন করার মতো যন্ত্র মোটে দুটি, যা দিয়ে বছরে সর্বোচ্চ তিনটি কূপ খনন করা যাবে। যদিও জমি অধিগ্রহণ এবং ভূমি উন্নয়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে তা-ও সম্ভব হয় না।

বাকি চারটির মধ্যে দুটি অনুসন্ধান খননযন্ত্র নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এর একটি ১৯৮৪ সালের, যা মেরামতে রাজি হয়নি কোনো বিদেশি ঠিকাদার। আর ১৯৮৭ সালেরটি মেরামতের আলোচনা চলছে। তবে মেরামত হলেও তা দিয়ে আর অনুসন্ধান করা যাবে না। পুরোনো কূপের সংস্কারে এটি কাজে লাগানো হবে। বাকি দুটি ওয়ার্কওভার কূপ খননে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অন্যদিকে ভারতীয় ওএনজিসির এখন খননযন্ত্র আছে ১৫০টি। নিজেদের দেশে সাফল্য দেখিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রেও গ্যাস অনুসন্ধান করছে তারা।

বাপেক্সের তিনজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো বিদেশি কর্মী ছাড়াই কাজ করে বাপেক্স। তবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবল কমে যাচ্ছে। নিয়মিত নিয়োগ না থাকায় কেউ অবসরে গেলে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এখন সংস্থায় মোট জনবল আছে ৫৯৪ জন, এর মধ্যে কর্মকর্তা ৩৫৯ জন। নিয়মিত নিয়োগ হয় না। সর্বশেষ নিয়োগ হয়েছিল ২০১৬ সালে। এখন নতুন করে নিয়োগপ্রক্রিয়া হাতে নেওয়া হয়েছে। নতুন কর্মী যুক্ত হলে বাপেক্স আরও শক্তিশালী হবে।

বিনিয়োগের অভাবে পিছিয়ে

বাপেক্স সবচেয়ে বেশি ভুগছে বিনিয়োগ নিয়ে। গ্রাহকদের টাকায় তৈরি গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে গ্যাস অনুসন্ধানে বরাদ্দ শুরু হয় ২০১২ সালে। এরপর থেকে সরকারি কোনো অর্থায়ন আসেনি বাপেক্সের প্রকল্পে। নিজস্ব অর্থায়নের পাশাপাশি জিডিএফ থেকে নিয়মিত ঋণ পেয়েছে তারা। যদিও সেই টাকায় কোম্পানির সক্ষমতা বাড়ানোর মতো কোনো প্রকল্প নেওয়া যায়নি; বরং সীমিত পরিসরে নিয়মিত অনুসন্ধানকাজ করে গেছে তারা।

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে জিডিএফ ব্যবহার করায় তহবিলও প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। দুই হাজার কোটি টাকা ধার হিসেবে দেওয়া হয়েছে এলএনজির ভর্তুকি বাবদ। পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাবের উদ্বৃত্ত অর্থ হিসাবে জিডিএফের তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ টাকা বিইআরসি ফেরত দিতে বললেও এখনো তা দেয়নি পেট্রোবাংলা। তাই জিডিএফ থেকেও বরাদ্দ পাচ্ছে না বাপেক্স। এখন সরকারি অর্থায়নে প্রকল্প নিতে বলা হয়েছে।

গ্রাহকের শোধ করা গ্যাসের দাম থেকে একটা অংশ যায় জিডিএফে। প্রতি মাসে ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকা এ তহবিলে জমা হয়। গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জিডিএফ থেকে এ পর্যন্ত চার হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে।

এর মধ্যে বাপেক্স নিয়েছে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। বাকিটা নিয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি। নতুন করে কোনো প্রকল্পে বরাদ্দ করার মতো টাকা নেই জিডিএফে।

বাপেক্সের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কূপ খননের পর গ্যাস না পাওয়া গেলে পুরো টাকা লোকসান হয়। গ্যাস না পেলে জিডিএফের টাকা ফেরত দিতে হতো না।

আর গ্যাস পেলে তা ফেরত দিতে হয় তহবিলে। কিন্তু সরকার ৪ শতাংশ সুদে ঋণ হিসেবে অর্থায়ন করবে। গ্যাস না পেলেও তা ফেরত দিতে হবে। অথচ চড়া দামে কূপ খননের পরও বালু ও পানি উঠে আসায় পাঁচটি কূপে গ্যাস উৎপাদন ধরে রাখতে পারেনি গাজপ্রম। সেই টাকা গাজপ্রম ফেরত দেবে না। এসব কূপ পরে সংস্কারকাজ করে গ্যাস উৎপাদন ফিরিয়ে এনেছে বাপেক্স।

নতুন কর্মী নিয়োগ হলে বাপেক্সের কাজের সক্ষমতা বাড়বে। এর সঙ্গে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আর বিনিয়োগ যুক্ত হলে বিশ্বমানের গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি হতে পারে বাপেক্স। এ সংস্থাকে পাঁচটি খননযন্ত্র দেওয়া হলে বছরে ১৫টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা যাবে।
বাপেক্সের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী

সাফল্যের অনন্য নজির

পেট্রোবাংলার অনুসন্ধান পরিদপ্তর বিলুপ্ত করে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদন কার্যক্রম গতিশীল করতে ১৯৮৯ সালে একটি কোম্পানি হিসেবে জন্ম নেয় বাপেক্স। শুরুতে শুধু অনুসন্ধান কোম্পানি হিসেবে তারা পেট্রোবাংলার অর্থায়নে চলত। এরপর অনুসন্ধান ও উৎপাদন কোম্পানি হিসেবে বাপেক্স যাত্রা শুরু করে ২০০২ সালে।

এখন পর্যন্ত গ্যাস অনুসন্ধানে ৪ হাজার ৭২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ এবং ১৭ হাজার ৭২১ লাইন কিলোমিটার এলাকায় দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করেছে তারা। গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে এ পর্যন্ত ১৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ১০টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে তারা। সাতটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখন নিয়মিত গ্যাস উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করছে বাপেক্স। বাকি তিনটি থেকে এখনো উৎপাদন শুরু হয়নি।

বাপেক্সের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী তাঁর ৩৯ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রথম আলোকে বলেন, নতুন কর্মী নিয়োগ হলে বাপেক্সের কাজের সক্ষমতা বাড়বে। এর সঙ্গে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আর বিনিয়োগ যুক্ত হলে বিশ্বমানের গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি হতে পারে বাপেক্স। এ সংস্থাকে পাঁচটি খননযন্ত্র দেওয়া হলে বছরে ১৫টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা যাবে।

বৈশ্বিকভাবে গড়ে প্রতি পাঁচটি অনুসন্ধান কূপের বিপরীতে একটিতে গ্যাস পাওয়া যায়। আর দুটির কম কূপ খনন করে একটিতে গ্যাস পেয়েছে বাপেক্স। গত ৯ মাসে বাপেক্স ২১ হাজার কোটি টাকার গ্যাস আবিষ্কার করেছে। বিদেশ থেকে আনা এলএনজির বর্তমান দাম বিবেচনায় নিলে এ গ্যাসের দাম ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাপেক্স আয় করেছে প্রায় ৬৭০ কোটি টাকা। মুনাফা ১২৩ কোটি টাকা।

বাপেক্সের বোর্ডে আমলাতন্ত্রের প্রভাব

স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বাপেক্স কাজ করছে। এভাবে পরিকল্পিত কাজের শুরুটা ২০১৯ সালে, চলবে ২০৪১ সাল পর্যন্ত। তবে এসব লক্ষ্যমাত্রা অধিকাংশ সময় পূরণ হয়নি। জ্বালানি বিভাগের পরামর্শে বারবার কাটছাঁট করা হয়েছে পরিকল্পনা। সারা দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের জরিপকাজ আরও দ্রুত করার দরকার ছিল। দেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, শিল্পকারখানা হচ্ছে। তাই জরিপ পরিচালনা করা কঠিন হবে। আগে সব জরিপ করা থাকলে তথ্য পরেও কাজে লাগানো যাবে।

বাপেক্স সূত্র বলছে, গত চার বছরে বাপেক্স ছয়টি কূপ খনন করে পাঁচটিতে গ্যাস পেয়েছে। এর মধ্যে একটির গ্যাস বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন লাভজনক মনে হয়নি। বাকি চারটি থেকে গ্যাস উৎপাদন করা যাবে। এমন সাফল্যের পরও কূপ খনন বাড়ানো যাচ্ছে না। বাপেক্স নিজস্ব সিদ্ধান্তে চলতে পারে না। যেকোনো প্রকল্প নিলে তা পেট্রোবাংলার মাধ্যমে জ্বালানি বিভাগের অনুমোদন নিতে হয়। মন্ত্রণালয়কে অনেক সময় যৌক্তিকভাবে বোঝাতে পারে না, বিনিয়োগে ভয় পান বাপেক্সের কর্মকর্তারা।

সাত সদস্যের একটি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয় বাপেক্স। এ বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব। এ ছাড়া আছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক-৩, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২ এবং বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর সরকারের বাইরে থেকে দুজন সদস্য রয়েছেন বোর্ডে। তাঁদের মধ্যে একজন ভূতত্ত্ববিদ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক। অন্যজন হলেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একজন বিশেষজ্ঞ।

বাপেক্স বোর্ডের সদস্য ভূতত্ত্ববিদ মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কূপে গ্যাস না পেলে তা ব্যর্থতা নয়। টাকা গচ্চা যাওয়া বলা যাবে না। কোনো কূপে গ্যাস না পেলেও সেখানকার তথ্য পাওয়া যাবে। গ্যাস না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হলে ওই এলাকা তখন অন্য কাজে লাগানো যাবে। তার মানে, অনুসন্ধান কূপ খনন সব সময়ই কাজে লাগে। ঝুঁকির ভয়ে কূপ খনন কম করার মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। এমন বিনিয়োগে সরকারের অনিচ্ছা থাকার কথা নয়। বাপেক্সকে সেভাবে প্রকল্প নিয়ে যেতে হবে।

এক যুগ বিভিন্ন দেশের গ্যাস খাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, প্রতি কূপে ২৫০ কোটি টাকা করে খরচ করলেও ২০টি কূপ খনন করতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এর মধ্যে যদি একটি কূপে মাত্র ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায়, উৎপাদন পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামে এর মূল্য সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। আর বর্তমান বিশ্ববাজারের দামে এটি ২৬ হাজার কোটি টাকা। আর এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলে তার দাম এক লাখ কোটি টাকার বেশি।

বাপেক্স সূত্র বলছে, গত চার বছরে বাপেক্স ছয়টি কূপ খনন করে পাঁচটিতে গ্যাস পেয়েছে। এর মধ্যে একটির গ্যাস বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন লাভজনক মনে হয়নি। বাকি চারটি থেকে গ্যাস উৎপাদন করা যাবে।

এগিয়ে নিতে দুই বাধা

বাপেক্সের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বাধা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী থাকাটাই হলো প্রশাসনিক বাধা। বাপেক্স নিজের সিদ্ধান্তে চলে না, জ্বালানি বিভাগের নতজানু হয়ে চলে। এভাবে বড় কোম্পানি হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়।

আর প্রকল্প বাস্তবায়নে নিজেদের তহবিল না থাকা হলো অর্থনৈতিক বাধা। ভারতের গ্যাস কোম্পানি ওএনজিসির বেতন জাতীয় বেতন স্কেলের দ্বিগুণ। আর বাংলাদেশের জাতীয় বেতন স্কেলের চেয়ে কম বেতন পান বাপেক্সের কর্মকর্তারা। তাই মেধাবীরা এখানে থাকেন না। তাঁরা বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিতে চলে যান উচ্চ বেতনের চাকরি নিয়ে।

উন্নত প্রযুক্তির একটি খননযন্ত্র কিনতে এখন ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন বাপেক্সের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, একটি যন্ত্র অন্তত ২০ বছর ব্যবহার করা যায়। ২০১২ সালের খননযন্ত্রটি কেনা হয়েছিল ২৫০ কোটি টাকায়।

যথেষ্ট দক্ষ কর্মী আছে বাপেক্সে। স্বকীয়তা নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না সংস্থাটি। তাদের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে বেশি দামে কূপ খনন করে গাজপ্রম। সংস্থাটির এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস এনে দেওয়া এ সংস্থায় বিনিয়োগও করা হয় না। কোনো একটা চক্র হয়তো চায় না, বাপেক্স সক্ষমতা অর্জন করুক। এভাবে পেট্রোনাস বা ওএনজিসি হওয়া সম্ভব নয়।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম

গত ১০ বছরে সরকার নতুন একটি খননযন্ত্র কিনতে পারেনি। গাজপ্রম দিয়ে দুটি কূপ খনন করতে যা খরচ হয়, তা দিয়ে একটি নতুন যন্ত্র কেনা সম্ভব। এ ছাড়া মাসে খোলাবাজার থেকে কেনা এক জাহাজ এলএনজি আনায় খরচ হয় ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। এক মাসে আসা দুই জাহাজ এলএনজির দাম বাপেক্স পেলে অন্তত ১০টি কূপ খনন করতে পারবে।

জ্বালানি বিভাগের কর্তৃত্বপরায়ণ প্রবণতা বাপেক্সকে গিলে ফেলেছে বলে মনে করছেন ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যথেষ্ট দক্ষ কর্মী আছে বাপেক্সে। স্বকীয়তা নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না সংস্থাটি। তাদের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে বেশি দামে কূপ খনন করে গাজপ্রম। সংস্থাটির এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস এনে দেওয়া এ সংস্থায় বিনিয়োগও করা হয় না। কোনো একটা চক্র হয়তো চায় না, বাপেক্স সক্ষমতা অর্জন করুক। এভাবে পেট্রোনাস বা ওএনজিসি হওয়া সম্ভব নয়।