আবু রেজা মো. নেজামুদ্দিন নদভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মোতালেবের সমর্থকদের মধ্যে অন্তত ১০টি হামলা, ভাঙচুর ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
দোকানি মো. সাবের (৫০)। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নের মরফলা এলাকায় তাঁর বাড়ি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে ভয়াবহ ঘটনার মুখোমুখি হন। তাঁদের কেন্দ্র পুরোনো বোর্ড অফিসের সামনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে এক কিশোরের প্রাণ যায়। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেননি তিনি। তাই নির্বাচন নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয় সাবেরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ভয় কাটেনি। আর এবারের নির্বাচনে তো এখনই গন্ডগোল চলছে। কী হয় দেখি।’ মরফলার আরও অন্তত পাঁচজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে একই চিত্র পাওয়া যায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচারণার শুরু থেকেই চট্টগ্রামের যে কয়েকটি আসনে সংঘাত থামছে না, তার মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনটি। এখানে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য নৌকা প্রতীকের আবু রেজা মো. নেজামুদ্দিন নদভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মোতালেবের সমর্থকদের মধ্যে এ নিয়ে অন্তত ১০টি হামলা, ভাঙচুর ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন। সংঘাতের জন্য দুই পক্ষই পরস্পরকে দোষারোপ করে আসছে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি তিনটি মামলাও হয়েছে। এসব মামলায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সবাই এখন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচারণায় এলাকা সরগরম থাকলেও ভোটের
দিন উপস্থিতি কতটুকু থাকবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মারামারি, হামলা–ভাঙচুর মানুষের আগ্রহ আরও কমিয়ে দিয়েছে।
এ পর্যন্ত নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটিতে পাল্টাপাল্টি ১৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে বড় চারটি মারামারির ঘটনায় প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী মামলাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থাও নেওয়া হয় বলে জানান সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিলটন বিশ্বাস। তিনি বলেন, অন্যান্য অভিযোগে মৌখিকভাবে সতর্ক করা, কারণ দর্শানো, জরিমানাসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সাতকানিয়া উপজেলার ১১ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভা এবং লোহাগাড়া উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন মিলে গঠিত চট্টগ্রাম-১৫ আসন। এবার মোট ভোটার ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৪১১ জন। এই আসনে টানা দুবারের (২০১৪ ও ২০১৮) সংসদ সদস্য আবু রেজা নদভী। ২০০৮ সালে এই আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আ ন ম শামসুল ইসলাম। আওয়ামী লীগ সেবার তৃতীয় হয়েছিল। এলডিপির অলি আহমদ ছাতা প্রতীক নিয়ে সেবার দ্বিতীয় হয়েছিলেন। এ ছাড়া এই আসনে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলামী জয়ী হয়। আর ১৯৯৬ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচন করে জেতেন অলি আহমদ।
একই দলের দুজন মুখোমুখি হওয়ার কারণে দক্ষিণ জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগও বিভক্ত। ঈগল প্রতীকের প্রার্থী মোতালেবের সাতকানিয়ায় প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য আ ম ম মিনহাজুর রহমান। একই কমিটির অন্তত পাঁচ নেতা রয়েছেন নৌকা প্রতীকের নদভীর পক্ষে। আবার সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরীসহ উপজেলা কমিটির একটি অংশও নৌকার সঙ্গে আছেন। বাকিদের একটি অংশ ঈগলের পক্ষে।
পাশের লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. সালাহউদ্দিন মোতালেবের পক্ষ নিয়েছেন। সহসভাপতি নুরুছ্চফা চৌধুরীসহ কয়েকজন নদভীর সঙ্গে রয়েছেন। দুই উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরাও বিভক্ত।
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি মোতালেবের পক্ষে জামায়াত–বিএনপির কিছু ভোটার কেন্দ্রে যাবেন, এমনটা আশা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ী মোতালেবের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাতকানিয়া–লোহাগাড়ার প্রায় চার হাজার কর্মী রয়েছেন। নির্বাচন উপলক্ষে ১ জানুয়ারি থেকে তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য কাজ করবেন বলে জানা গেছে।
পাশাপাশি মোতালেবের ছোট ভাই মাহমুদুল হক সদর ইউনিয়নের জামায়াত–সমর্থিত সাবেক চেয়ারম্যান। তিনিও ভাইয়ের নির্বাচনে কাজ করছেন। আবার চট্টগ্রাম নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক সাতকানিয়ার ব্যবসায়ীদের একটি অংশের ভোট ঈগলের দিকে যাবে বলে ধারণা করছেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা।
অন্যদিকে নদভী জামায়াতে ইসলমীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য প্রয়াত মুমিনুল হক চৌধুরীর জামাতা। সেদিক থেকে জামায়াতে ইসলামীর একটি অংশের সমর্থন তিনি পেতে পারেন। কিন্তু গত ১০ বছরে জামায়াতের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে নানা মামলার কারণে নদভীর ওপর ইসলামি দলটির কেউ কেউ ক্ষিপ্ত। এসব ভোটার কেন্দ্রে গেলে মোতালেবের পক্ষে ঝুঁকতে পারেন বলে আলোচনা আছে।
আবদুল মোতালেব গতকাল লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নে প্রচারণা চালিয়েছেন। সকাল থেকে আট–দশটি গাড়ি নিয়ে চৌধুরীপাড়া, কাজীপাড়া পার হয়ে বাঁশখালী পাড়ায় গণসংযোগ করেন। আবদুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দু–একজন ছাড়া সব নেতা ও চেয়ারম্যান আমার সঙ্গে আছেন। দলমত নির্বিশেষে মানুষের সমর্থন পাচ্ছি।’
আবু রেজা নদভী গতকাল এলাকায় ছিলেন না। তাঁর পক্ষে স্ত্রী রিজিয়া নদভী লোহাগাড়ার চরম্বা ইউনিয়নে বিকেলে প্রচারণা চালিয়েছেন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আবু রেজা নদভী বলেন, ‘তাঁরা (আবদুল মোতালেব) জামায়াতকে নিয়ে রিয়াজউদ্দিন বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করছেন। তাঁদের সঙ্গে জামায়াতের কিলিং টিম কাজ করছে। আমার স্ত্রীর ওপর হামলার ঘটনায় সেভাবে ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।’
এই আসনে এবার প্রার্থী সাতজন। নৌকা ও ঈগল ছাড়াও আসনটিতে মোমবাতি প্রতীকে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মুহাম্মদ আলী হোসাইন, হাতঘড়ি প্রতীকে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মুহাম্মদ সোলাইমান কাসেমী, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ ছালেম, মিনার প্রতীকে ইসলামী ঐক্যজোটের মোহাম্মদ হারুন ও ছড়ি প্রতীকে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের মো. জসিম উদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে সাতকানিয়ার ১০টি ও লোহাগাড়ার ৫টি এলাকা ঘুরে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্রের বাইরে কারও তেমন প্রচারণা চোখে পড়েনি।
গত বছর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই আসনের সাতকানিয়ায় ভোটের দিন প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির পাশাপাশি দুটি খুনের ঘটনা ঘটে। এবার সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিন কী হয়, এ নিয়ে ভোটাররা উদ্বেগের মধ্যে আছে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে এই আসনের কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে বলে জানালেন সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শিবলী নোমান। তিনি বলেন, প্রথম দিকে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এখন একটু শান্ত আছে পরিস্থিতি।