টানা চার দিনের জলাবদ্ধতায় নগরের বিভিন্ন সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টানা বর্ষণে এসব সড়কের কোথাও পিচ ওঠে গেছে, কোথাও গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে চালক ও যাত্রীদের। আজ বেলা ১১টায় নগরের জাকির হোসেন সড়কের ঝাউতলা রেল ক্রসিং এলাকার চিত্র। চট্টগ্রাম, ১০ আগস্ট
টানা চার দিনের জলাবদ্ধতায় নগরের বিভিন্ন সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টানা বর্ষণে এসব সড়কের কোথাও পিচ ওঠে গেছে, কোথাও গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে চালক ও যাত্রীদের। আজ বেলা ১১টায় নগরের জাকির হোসেন সড়কের ঝাউতলা রেল ক্রসিং এলাকার চিত্র। চট্টগ্রাম, ১০ আগস্ট

চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতার পর এবার ভাঙা সড়কে দুর্ভোগ

জলাবদ্ধতার কষ্টের পর এবার ভাঙা সড়কের যন্ত্রণার মুখোমুখি বন্দরনগর চট্টগ্রামের মানুষ। টানা চার দিনের জলাবদ্ধতায় নগরের মূল সড়কের পাশাপাশি শাখা সড়কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টানা বর্ষণে এসব রাস্তাঘাটের কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের এই দশায় কষ্ট নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে চালক ও যাত্রীদের। গাড়ি চলাচলেও ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।

বর্ষা মৌসুমে নগরের সড়ক নষ্ট হওয়ার এই প্রবণতা এবার নতুন নয়। প্রতি বছরই ভারী বর্ষণ ও জোয়ারে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরের রাস্তাঘাট বেহাল হয়ে পড়ে। কোনো বছর বেশি, কোনো বছর কম। এই বছর এখন পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ার তালিকা করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

৩ আগস্ট রাতে চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণ শুরু হয়। এই বৃষ্টি ও পূর্ণিমার অস্বাভাবিক জোয়ারে শুক্রবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতা শুরু হয়। এই জলাবদ্ধতা ছিল গত সোমবার পর্যন্ত। এবারের জলাবদ্ধতায় নগরের ৪০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। অধিকাংশ এলাকায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত পানি জমে ছিল। কিছু কিছু এলাকা টানা চার দিন ধরে পানিতে তলিয়ে থাকে।

রাস্তাঘাট থেকে পানি নামার পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের একটি তালিকা করে। এই তালিকা অনুযায়ী, এবারের জলাবদ্ধতায় নষ্ট হওয়া সড়কের পরিমাণ ৫০ কিলোমিটার। এ ছাড়া দুই কিলোমিটার নালা-নর্দমা ও দুই কিলোমিটার ফুটপাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো সংস্কারে ৬০ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানান সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা।

সড়কে গর্তে পড়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চাকা খুলে গেছে। আজ দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম নগরের সিডিএ এ্যাভিনিউ সড়কের শুলকবহর এলাকার চিত্র। চট্টগ্রাম, ১০ আগস্ট

সড়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রেনেজব্যবস্থার দুর্বলতা ও কাজের গুণগত মান খারাপসহ তিন কারণে চট্টগ্রাম নগরের রাস্তাঘাট বৃষ্টির সময় নষ্ট হয়ে পড়ে। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা বলছেন, অতিবৃষ্টির কারণে নগরের সড়কগুলোর এই হাল হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাবে নগরে সাড়ে তিন হাজার সড়ক রয়েছে। এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার।

রাস্তায় বড় গর্ত, ভেঙেছে গাড়ির চাকা

এবারের জলাবদ্ধতায় চার দিনও ডুবেছিল নগরের অন্যতম প্রধান সড়ক সিডিএ অ্যাভিনিউয়ের মুরাদপুর, শুলকবহর ও বহদ্দারহাট অংশ। পানি নেমে যাওয়ার পর এসব অংশে সড়কের ক্ষত বেরিয়ে এসেছে।

জলাবদ্ধতা শুরুর আগে আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়ক (মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার) ও এম এ মান্নান উড়ালসড়কের (বহদ্দারহাট) মধ্যবর্তী অংশ উঁচু করার জন্য ইটের খোয়া আর বালি ফেলেছিল সিটি করপোরেশন। কিন্তু জলাবদ্ধতায় তা অনেকটাই ভেসে গেছে। এতে সড়কে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় খানাখন্দের।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে নগরের বহদ্দারহাট থেকে এই সড়ক দিয়ে আতুরার ডিপো এলাকায় যাচ্ছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক মো. খলিলুর রহমান। কিন্তু সড়কের একটি গর্তে পড়ে তাঁর গাড়ির সামনের চাকা ভেঙে যায়। এই অবস্থায় কী করবেন, তার দিশা পাচ্ছিলেন না তিনি। এই সময় প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন সড়কে গাড়ি চালানো অনেক কষ্ট। তাই সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। এরপরও একটি গর্তে পড়ে চাকা ভেঙে গেছে। এখন কীভাবে গন্তব্যে যাব, কীভাবে গাড়ি ঠিক করব, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম।’

শুধু দুই উড়ালসড়কের মাঝখানের অংশ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উড়ালসড়কের ওঠানামার দুই পাশের রাস্তাও। সেখানে বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে। আবার রাস্তাজুড়ে জমে রয়েছে কাদা। এর মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলছে পণ্যবাহী ভারী গাড়ি। চলাচল করছে বাস, অটোরিকশা, প্রাইভেট কার, রিকশা।

গত সোমবার পানি নামার গত মঙ্গল ও বুধবার নগরের ১০টি সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, এসব সড়কের অনেক জায়গায় পিচঢালাই (কার্পেটিং) নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় সড়কে দুই থেকে ছয় ইঞ্চি গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ছোট-বড় হাজার হাজার পাথর। এগুলো দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করেছে।

সড়কের কোথাও পিচ ওঠে গেছে, কোথাও খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। নগরের সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়কের শুল্কবহর এলাকায় আজ দুপুরের চিত্র। চট্টগ্রাম, ১০ আগস্ট

এবারের বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উল্লেখযোগ্য সড়কগুলোর মধ্যে রয়েছে নগরের কে বি আমান আলী সড়ক, জামালখান সড়ক, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ সড়ক, লয়েল রোড, কে সি দে সড়ক, খাজা সড়ক, চান মিয়া সড়ক, বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক, হাটহাজারী (মুরাদপুর-অক্সিজেন) সড়ক, সার্সন সড়ক, ডিসি সড়ক, ওমর আলী মাতব্বর সড়ক, মাইজপাড়া সড়ক, পিলখানা সড়ক, জাকির হোসেন সড়ক, সুন্নিয়া মাদ্রাসা সড়ক, মোহাম্মদপুর সড়ক, খতিবের হাট সড়ক। এর মধ্যে অনেকগুলো সড়ক আগে থেকে খারাপ ছিল। ভারী বৃষ্টিতে তা আরও নষ্ট হয়েছে৷  

সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মুনিরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছরের তুলনায় এবার জলাবদ্ধতা বেশি হয়েছে। এ কারণে নগরের ৫০ কিলোমিটারের মতো রাস্তাঘাট ভেঙেছে৷ পানি জমে থাকলেই সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নষ্ট হওয়া সড়ক সংস্কারের জন্য প্রয়োজন ৬০ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে এই টাকা বরাদ্দ চাওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে রোদ উঠলেই সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সড়ক সংস্কার করে দেওয়া হবে।

তিন কারণে ভাঙছে সড়ক

এবারের মতন প্রতিবছরই জলাবদ্ধতার পর নগরের সড়কগুলোর ক্ষতবিক্ষত চেহারা বেরিয়ে আসে। এমনকি সংস্কারের কিছুদিন পরও সড়ক নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
গত বছর নগরের প্রায় ১০০ কিলোমিটার সড়ক নষ্ট হয়েছিল। ২০২১ সালে অবশ্য কম সড়ক নষ্ট হয়, এর পরিমাণ ছিল ৩৬ কিলোমিটার। সবচেয়ে বেশি সড়ক নষ্ট হয়েছিল ২০১৭ সালে, ওই বছর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল৷ আর ২০১৯ ও ২০২০ সালে ২০০ কিলোমিটার করে সড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছিল।

জলাবদ্ধতার সময় এভাবে সড়ক নষ্ট হওয়ার জন্য তিনটি কারণকে দায়ী করেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বিটুমিন সড়কের বড় শত্রু পানি। কোনো কারণে সড়কে পানি জমে থাকলে এবং এর ওপর দিয়ে ভারী গাড়ি চলাচল করলে সড়ক নষ্ট হয়ে যাবে।

এমন সড়কে চরম ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে মানুষজনকে। নগরের বহদ্দারহাটে সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়কের চিত্র। চট্টগ্রাম, ১০ আগস্ট

সড়ক পরিবহন–বিশেষজ্ঞ এই অধ্যাপক বলেন, চট্টগ্রামের সড়কগুলো নষ্ট হওয়ার জন্য তিনটি কারণ রয়েছে৷ প্রথমত, শহরের ড্রেনেজব্যবস্থা ভালো না। যার কারণে শহরে জলাবদ্ধতা হয়। এতে রাস্তাঘাট ভেঙে যায়। দ্বিতীয়ত, সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়, তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ কারণে সড়ক সংস্কার করলেও বেশি দিন টেকে না। আর তৃতীয়ত, নির্মাণ ও সংস্কারের সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে নজরদারি ও তদারক করা প্রয়োজন, সিটি করপোরেশন সেটি করে না। এই কারণে ঠিকাদারেরা কোনোরকমে কাজ সারেন। যার ফলে প্রাথমিকভাবে ঠিক থাকবে মনে হলেও, বাস্তবে বছর পার হতেই সড়ক ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।