ইয়েমেনের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে দেশটির আবিয়ান ও সাবওয়াহ্ প্রদেশে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা ছিল। সেখানে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য গিয়েছিলেন এডেনে জাতিসংঘের সাব–অফিসে নিরাপত্তা সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ কে এম সুফিউল আনাম। কিন্তু তিনি ও তাঁর দলকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে। ৫৪৫ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে মুক্তি পান তিনি। সেই জিম্মিদশার রোমহর্ষক বর্ণনা তিনি দিয়েছেন প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি লেখায়। তাঁর সেই লেখাটি পাঠকদের জন্য তিন পর্বে প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব।আগামীকাল প্রকাশিত হবে তৃতীয় পর্ব: ‘কী কারণে জানি না, আমাদের হাত ও চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো’
আগের রাতেই হোটেলের বিল পরিশোধ করে রেখেছিলাম। সকাল ছটায় শুরু হলো এডেনের পথে ফিরতি যাত্রা। আমি আমার কর্মীদের পরবর্তী কর্মপন্থা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলাম। পথে দামত নামে একটা জায়গায় উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। স্থানীয় লোকজন এই উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করে ও হাত-পা ধুয়ে থাকে। এর গরম পানি বাত ও অন্যান্য ব্যথা উপশম করে বলে স্থানীয় মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আছে। আমার গাড়িচালক খালেদ আমার হাঁটুর ব্যথার কথা জানত। সে আমাকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করে বলে, আমরা যেন অবশ্যই দামতে নেমে প্রস্রবণের পানি দিয়ে হাঁটু ও হাত-পা ধুয়ে নিই। সিদ্ধান্ত হলো, আমরা সেখানে থেমে হাত-পা ধুয়ে নেব।
আরও ঘণ্টাখানেক চলার পর সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা দামতে গিয়ে পৌঁছাই। গাড়ি দুটি এসকর্টদের দায়িত্বে রেখে আমরা প্রস্রবণের পানিতে হাত-পা ধুতে যাই। ঘণ্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে আবার রওনা দিলাম আবিয়ানের উদ্দেশে। ওয়াদিয়াহ্র মধ্য দিয়ে মুদিয়াহ হয়ে আমরা যাব এডেনের দিকে। এডেনে যাওয়ার আগে পথে আরেকবার এসকর্ট বদল করতে হবে। এডেন পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যাবে।
দু-আড়াই ঘণ্টা চলার পর আমরা পৌঁছালাম লাহমার নামে ছোট্ট একটি জায়গায়। বাজারের মাঝখানে গাড়ি থামানো হলো। নিরাপত্তা এসকর্টের সদস্যরা এখানে দুপুরের খাবার খাবে। আমরাও কিছু খেয়ে নেব। লাহমারের ভেড়া বা খাসির মাংস এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ খাবার। মাংস, চাল ও অন্যান্য মসলাপাতি বড় হাঁড়িতে নিয়ে ভালো করে মুখ বন্ধ করে মাটিচাপা দিয়ে চারদিক থেকে আগুনে জ্বালিয়ে একধরনের খাবার রান্না করা হয়। খাবারটির নাম লাহম। এখানকার সবার প্রিয় খাবার। আমরা লাহমের অর্ডার দিয়ে ছোট্ট একটা ঘরে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর একটা বড় থালায় লাহম এল। সবাইকে একই থালা থেকে খাবার খেতে হবে। ছোট-বড়-ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাই একই থালা থেকে খাবে। এটাই আরবরীতি।
প্রায় ৪০ মিনিটের যাত্রাবিরতির পর আবার রওনা হলাম। ১৫ থেকে ২০ মিনিট চলার পর গাড়ির জ্বালানির জন্য ফিলিং স্টেশনে থামতে হলো। প্রায় পৌনে দুইটা বাজে। আবার চলা শুরু। আমি আইপ্যাডে ম্যাপের সঙ্গে রাস্তা মিলিয়ে দেখছি। গাড়িচালককে জিজ্ঞাসা করলাম, এডেন পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে? সে জানাল, ইনশা আল্লাহ, আর দু-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব। আমার সহযাত্রী ইয়েমেনি কর্মীরা লাহমার বাজার থেকে কাত কিনে নিয়েছিলেন। গাড়িতে বসে তাঁরা কাত চিবাতে লাগলেন।
আইপ্যাডের ম্যাপে চোখ রেখে কানে এয়ারপড গুঁজে গান শুনতে শুনতে চলছি আর প্রহর গুনছি কখন এডেন পৌঁছাব। ১৭ তারিখে আমার ছুটি। ছুটিতে দেশে যাব। সবকিছু গুছিয়ে সেই ব্যাগ নিয়েই এই মিশনে এসেছি। কিন্তু তখন ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি, কিছুক্ষণ পরই যে ঘটনা ঘটতে চলেছে, তাতে ১৭ তারিখ তো দূরের কথা, পরের দেড়টি বছর দেশ, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের ছায়াও আমি দেখতে পাব না।
চোখের নিমেষে ঘটে গেল সেই অপহরণ-কাণ্ডটি, এই লেখার শুরুতে যার বর্ণনা করেছি। আরব উপদ্বীপের আল-কায়েদা বা আল-কায়েদা অব অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা (একিউএপি) জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা আমাদের বন্দী করে নিয়ে গেল। আমাদের অপহরণ করে তাদের দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে অরণ্যসংকুল পর্বতে এবং উত্তপ্ত বালুময় মরুভূমিতে আটকে রাখল দেড় বছর। এরপর জনবিচ্ছিন্ন পর্বতমালার গভীরে পাথরের তৈরি আস্তানায় রাতের পর রাত কাটিয়েছি ভূমিশয্যায়। মাসের পর মাস কাটাতে হয়েছে তপ্ত মরুভূমিতে বেদুইনদের তাঁবুতে, যেখানে মাঝেমধ্যেই ওঠে ধূলিঝড়। চোখ বাঁধা অবস্থায় এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বিপৎসংকুল পর্বতের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, ওত পেতে থাকা মৃত্যুফাঁদের মধ্য দিয়ে।
১৮ মাসে ১০টি জায়গায় আমাদের স্থানান্তরিত করা হয়। আমার বয়সী একজন লোকের পক্ষে বিনা চিকিৎসায়, অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন যাপন করা হয়ে উঠছিল দুরূহ। সবার ওপরে ছিল বেঁচে থাকা না-থাকার অনিশ্চয়তা আর পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তা। মহান আল্লাহর রহমতে সামরিক প্রশিক্ষণে কঠোর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার কারণেই সম্ভবত টিকে ছিলাম। সন্ত্রাসীরা বাহ্যত আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেনি। তবে সব সময় আমাকে সন্দেহের চোখে দেখত। আমাকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী এবং মার্কিন গুপ্তচর বলে ভেবেছিল। আমি যে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, সেটা তারা দেখত। তারা ভাবত, আমি যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান এবং আমার প্রতিটি পদক্ষেপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করত। সামান্য সন্দেহ জাগলেই আমাকে চোখ বেঁধে ঘরের বাইরে নিয়ে ঘরে তল্লাশি চালাত। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলত। আমি ধৈর্য না হারিয়ে আল্লাহর সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করতাম।
অপহরণের পর চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো এবড়োখেবড়ো পাথরের একটা গুহার ভেতর। সেই গুহাকে তারা আশ্রয়স্থল বানিয়েছে। সেটির একটিমাত্র লোহার দরজা। কোনো জানালা নেই। আলো-বাতাস চলাচলের জন্য মাটি থেকে ফুট দেড়েক উঁচুতে ছোট ছোট কয়েকটি ঘুলঘুলি। জায়গার অবস্থা দেখে কিছু বুঝতে পারলাম না। মনে হলো বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছি। শুধু ভাবছিলাম, আমাদের কী হতে চলেছে, এরপর কী হবে? আমরা অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হলাম।
দিন তিনেক পর তারা আমার দলের আরও তিন সদস্যের মধ্য থেকে একজনকে ধরে এনে আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিল। বাকি দুজন রয়ে গেল অন্য কোনো অজানা স্থানে। তারা কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছুই জানতে পারলাম না।
চার থেকে পাঁচ দিন পর তারা আমাদের তিনজনকে প্রথমবারের মতো স্থানান্তর করল। গাড়িতে করে সেখানে যেতে আরও চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগল। রওনা দেওয়ার আগে বলা হয়েছিল, আমাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য রিলিজ পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু যে জায়গায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো, সেখানকার পরিবেশ ও তাদের প্রস্তুতি দেখে আমার মনে হলো, আমাদের এই অবস্থান বেশ দীর্ঘস্থায়ী হবে। জায়গাটা পাহাড়ের আরও গভীরে আরেকটি আস্তানা।
দু-তিন দিন পর অপহরণকারীদের খুব উৎফুল্ল বলে মনে হলো। কারণ বোঝা গেল না। একদিন ছয় থেকে সাতজনের একটি দল এল আমাদের ভিডিও বার্তা তৈরি করতে। সেটা তারা আমাদের সংস্থা, অর্থাৎ জাতিসংঘের কাছে পাঠাবে। সেখানে তাদের দাবিদাওয়া আর আমাদের মুক্তিদানের শর্তগুলো থাকবে। জাতিসংঘ তাদের দাবি ও শর্তগুলো পূরণ করতে রাজি হলেই কেবল আমাদের মুক্তি দেওয়া হবে। আমাদের মনে একটু আশার সঞ্চার হলো। জাতিসংঘের নিরাপত্তা বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমার জানা ছিল, এ ধরনের অপহরণের ক্ষেত্রে মুক্তিপ্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ সাধারণত এ রকমই হয়। এ রকম ভিডিও বার্তার মাধ্যমে জাতিসংঘ জানতে পারে যে তাদের অপহৃত কর্মীরা জীবিত আছেন। একে বলা হয় প্রুফ অব লাইফ। জাতিসংঘ অপহৃত কর্মীদের প্রুফ অব লাইফ পাওয়ার পর তাঁদের মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে।
অপহরণকারীরা বেশ ঘটা করে আমাদের নিয়ে ভিডিও বার্তা ধারণ করল। তাদের মধ্যে বেশ উৎসাহ লক্ষ করলাম। তারা বারবার আমাদের মুক্তির আশ্বাস দিতে লাগল। আমরাও আশান্বিত হয়ে উঠলাম। তাদের এসব আশ্বাসবাণী শুনতে শুনতে ২০২২ সালের পবিত্র রমজান মাস চলে এল। এবার তারা আশ্বাস দিয়ে বলল, রমজান মাসের মধ্যেই আমাদের মুক্তি দেওয়া হবে। আমরা অধীর হয়ে দিন গুনতে লাগলাম।
এর মধ্যে আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। অপহরণকারীরা আমার চিকিৎসার আশ্বাস দিল, কিন্তু চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই আসলে ছিল না। তাদের নিজেদের মধ্যেও কেউ অসুস্থ হলে বা কেউ গুরুতরভাবে জখম হলে পেশাদার চিকিৎসকের সেবা পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। চিকিৎসা বা শুশ্রূষা সম্পর্কে যৎসামান্য ধারণা আছে, এমন কোনো সন্ত্রাসীই যতটা সম্ভব চিকিৎসা দিত। সে রকমই একজনকে আমার চিকিৎসার ভার দেওয়া হলো। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি কিছুটা সুস্থ বোধ করলাম। তবে এটা বুঝে গেলাম, এখানে গুরুতর অসুস্থ হলে মৃত্যু ছাড়া কোনো পথ নেই। নিজেকে পুরোপুরি মহান আল্লাহ তাআলার কাছে সমর্পণ করলাম।
এভাবেই রমজান মাস পার হতে লাগল। আমরা মাসজুড়ে শুনতে থাকলাম, ঈদের আগেই আমাদের মুক্তি দেওয়া হবে, আমরা স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে পারব। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি দিয়ে রমজান মাস শেষ হয়ে এল। ২০২২ সালের ২ মে স্বদেশ-স্বজন থেকে বহুদূরে ইয়েমেনের এক গভীর অরণ্যে পাথুরে পাহাড়ের এক রুদ্ধদ্বার প্রকোষ্ঠে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আমরা ইয়েমেনি রীতিতে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করলাম। ঈদের আনন্দ হিসেবে শুনতে পেলাম তাদের একে-৪৭ রাইফেলগুলোর গুলির শব্দ।
ইতিমধ্যে আরও তিন থেকে চারবার আমাদের দিয়ে ভিডিও ক্লিপ তৈরি করা হয়। খুব আশা নিয়ে সেগুলো তৈরিতে আমরা সহযোগিতা করলাম। কিন্তু মুক্তির কোনো নিশানাই দেখা গেল না। হতাশা ও গভীর অনিশ্চয়তায় আমাদের দেহ-মন শ্রান্ত হয়ে পড়ল। এর মধ্যে অপহরণকারীদের অর্থ ও রসদ ফুরিয়ে আসতে শুরু করল। আর তার সরাসরি প্রভাব পড়ল আমাদের ওপর। টান পড়তে শুরু করল আমাদের খাদ্যদ্রব্য, পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহে। অপহরণকারীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিতে শুরু করল। আমাদের দুশ্চিন্তাও সেই সঙ্গে বেড়ে চলল। এবার কী হবে? কঠিনতর পরিস্থিতির জন্য আমরা নিজেদের মানসিক প্রস্তুত করতে শুরু করলাম। একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হলো যে দুই বেলা খাবারও পাচ্ছি না, প্রয়োজনমতো খাওয়ার পানি পাচ্ছি না। এভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে পার হয়ে গেল আরও একটি মাস।
২৪ জুন সন্ধ্যায় তারা আমাদের কাছে এসে হঠাৎ বলল, ‘তৈরি হয়ে নাও। তোমাদের অন্যখানে নিয়ে যাওয়া হবে।’ কোথায় যাব, কেন যাব, কিছুই জানানো হলো না। অপহরণকারীরা যে আমাদের স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা আমাদের জানা ছিল না। তারা আমাদের নিয়ে কখন কী করতে যাচ্ছে, তার কিছুই আমরা আগে থেকে বুঝতে বা জানতে পারতাম না। তাদের নির্দেশে আমরা আমাদের যৎসামান্য জিনিসপত্র বেঁধেছেঁদে প্রস্তুত হলাম।
রাত ১১টার দিকে চোখ বেঁধে আমাদের গাড়িতে তোলা হলো। আবার যাত্রা শুরু হলো অজানা কোনো গন্তব্যের দিকে। পথে দু-তিনবার গাড়ি বদল হলো। গন্তব্যে পৌঁছালাম প্রায় ভোরের দিকে। আবার সেই একই জায়গা, অপহরণ করার পর যেখানে আমাদের প্রথম এনে রাখা হয়েছিল। জায়গাটার নাম আমরা দিয়েছিলাম রুস্টার। সেই একই এবড়োখেবড়ো পাথুরে ঘর, তবে পোকামাকড়ের উপদ্রব এবার আগের চেয়ে বেশি।
সন্ত্রাসীদের স্থানীয় নেতা আমাদের বলল, মুক্তিপ্রক্রিয়ায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ঈদুল আজহার আগেই ইনশা আল্লাহ আমরা মুক্ত হয়ে যাব। এর আগে চার থেকে পাঁচ দিন এখানে আমাদের থাকতে হবে। এখান থেকে আমাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য অন্য একটি রিলিজ পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হবে কিংবা আরও ভালো কোনো বাসস্থানে স্থানান্তর করা হবে। আবার আমরা মুক্তির আশায় বুক বাঁধলাম।
২৮ জুন রাতে কিছুই না বলে আবার আমাদের চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হলো। কারও মুখে কোনো কথা নেই। পরিস্থিতি বেশ গম্ভীর। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠতে শুরু করল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। পথে দুবার গাড়ি বদল হলো। কোথায় যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। গাড়ি চলছে কখনো ঝড়ের গতিতে, কখনো ধীরে ধীরে, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে। এভাবে ঘণ্টা তিন-চারেক চলার পর তারা আমাদের চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বুঝতে পারলাম, আমরা কোনো নিয়মিত সড়কপথ দিয়ে যাচ্ছি না। যাচ্ছি বড় বড় পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে খাদের মধ্য দিয়ে। ভেবে পেলাম না, এ রকম পথ দিয়ে গাড়ি চলছে কীভাবে। অস্ত্র ও ড্রাগ চোরাচালানকারীরা সামরিক বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টি এড়িয়ে চলার জন্য এসব পথ ব্যবহার করে।
গাড়ি আরও ঘণ্টা দুয়েক চলল। আমরা একটা এক্সচেঞ্জ পয়েন্টে থামলাম। থামার সঙ্গে সঙ্গে আবার আমাদের চোখ বেঁধে ফেলা হলো। এখানে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর আরেকটি গাড়ি এল। গাড়িটিতে আমাদের উঠিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু হলো পাহাড়ি সেই রাস্তার মধ্য দিয়ে। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম গাড়ির গতি বেড়েছে। আগের মতো ঝাঁকুনিও আর লাগছে না। খুব সন্তর্পণে চোখের বাঁধনের একটি কোণ উঁচু করে দেখার চেষ্টা করলাম। দেখি, এবার আমরা একটা খোলা প্রান্তরের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছি। একটু ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, আমরা যাচ্ছি মরুভূমির মাঝখান দিয়ে। গাড়িটা দুর্বার গতিতে চলছে। চালক খানাখন্দ বা গর্ত, কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে বসে থাকাই অসাধ্য হয়ে উঠল।
সাময়িক বিরতি দেওয়া হলো। চোখের বাঁধন খুলে দিলে বুঝলাম, ভোর হয়ে আসছে। এটা নামাজের বিরতি। আমরা তায়াম্মুম করে নামাজ পড়লাম। নামাজের পর আবার শুরু হলো চলা। বিকেল চারটা নাগাদ একটা শহরতলিতে পৌঁছালাম। এর সবই আন্দাজে বোঝার চেষ্টা করছি, চারপাশের আওয়াজ আর গাড়ির শব্দ শুনে।
এবার আমাদের তোলা হলো একটা বাড়িতে। চোখের বাঁধন খোলার পর দেখতে পেলাম, মরুভূমির মাঝখানে একটি এলাকা। আশপাশে বেশ কিছু ঘরবাড়ি আছে। আমাদের ঘরটা সাধারণ মানুষের বসবাসের উপযোগী একটা ঘর। কয়েকটা জানালা আছে, দরজা একটাই। মেঝেতে কার্পেট, মাথার ওপরে সিলিং ফ্যান, দেয়ালে বৈদ্যুতিক বাতি। ঘরের সামনে করিডর। এক পাশে একটা বাথরুম।
চার মাস পর এই প্রথম মানুষের বসবাসের উপযোগী কোনো ঘরে উঠলাম। মনে মনে খুশি হয়ে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম। তখন কি আর জানতাম, এই সুখ মাত্র সাত থেকে আট দিনের বেশি স্থায়ী হবে না!
ঈদুল আজহার আট থেকে দশ দিন আগে অপহরণকারীরা আমাদের বলল, ঈদের আগেই আমাদের মুক্তি দেওয়া হবে, সে রকম কথাবার্তা চলছে। তবে অবস্থা দেখে তা মনে হলো না। আমরা টের পাচ্ছিলাম, আমাদের উপস্থিতিতে বাড়ির মালিক খুব একটা সন্তুষ্ট নন। বিশেষ করে আমার উপস্থিতি আর ইংরেজিতে কথা বলার ব্যাপারে তাঁর মধ্যে খুব আপত্তির ভাব। আমাদের বলা হলো, কথা বলতে হবে আস্তে। আমাকে বলা হলো ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ না করতে। বাড়িওয়ালার আশঙ্কা, সন্ত্রাসী অপহরণকারীদের তিনি জিম্মিসহ আশ্রয় দিচ্ছেন কিংবা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে, এ কথা জানাজানি হলে তিনি বিপদে পড়বেন।
আমরা এখন পাহাড়ি জঙ্গলের গুহায় নেই। লোকালয়েই আছি। তুলনামূলকভাবে ভালো একটা ঘরে থাকছি। ঘরে লাইট-ফ্যান আছে। কিন্তু এসবের স্বাদ আমরা নিতে পারছিলাম না। মনে হলো, পাহাড়ের আস্তানাই ভালো ছিল। সেখানে অন্তত খোলামেলাভাবে কথা বলতে পারতাম। বন্দী অবস্থায় কথাও বলতে না পারায় হাঁপিয়ে উঠলাম।
শ্বাসরুদ্ধকর এই অবস্থা অবশ্য দীর্ঘ হলো না। কোরবানির ঈদের ঠিক এক দিন আগে বাড়ির মালিক আমাদের প্রায় জোর করে বের করে দিলেন। কারণ, সেখানে আমাদের অবস্থান তাঁর নিজের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
অপহরণকারীরা এবার আমাদের নিয়ে চলল আরেক ঠিকানায়। আবারও চোখ বাঁধা অবস্থায় বিপৎসংকুল পথে ছুটে চলা।
এই যাত্রায় গাড়ি উল্টে আমাদের প্রাণ হারানোর উপক্রম হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। আবার যাত্রা শুরু করার পর চারদিকের শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ঝোড়ো আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে চলেছি। একটি জায়গায় থেমে গাড়ি থেকে আমাদের নামানো হলো। সঙ্গে সঙ্গে মুখে এসে লাগল ধুলাবালুর ঝাপটা। প্রবল ঝোড়ো বাতাস আর বালুর রাস্তা ধরে আমাদের ওরা হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। আমাদের থামাল কোনো একটা কিছুর সামনে পৌঁছে। কাপড়ের পর্দার মতো কিছু একটা সরিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ভেতরে।
চোখের বাঁধন খুলে দিলে দেখতে পেলাম, চারপাশে কাপড়ের দেয়াল। মাথার ওপরে কাপড়ের ছাদ। বুঝলাম, আমাদের একটা তাঁবুর ভেতরে ঢোকানো হয়েছে। বাইরে প্রচণ্ড ধূলিঝড় চলছে। ধুলার ঝাপটায় তাঁবুর ভেতরেও ভালোভাবে চোখ খুলে তাকানো যাচ্ছে না। নিশ্বাসও নেওয়া যাচ্ছে না। সে অবস্থায় তাঁবুর খুঁটি ধরে কোনোরকমে মাটিতে বসে পড়লাম। এখানে এই আবহাওয়ায় কীভাবে থাকব, ভেবে কূলকিনারা পেলাম না। কিন্তু কোনো কিছুই তো আর আমাদের হাতে নেই। অপহরণকারীরা যেখানে যেভাবে রাখবে, সেখানেই আমাদের থাকতে হবে। এটাই আমাদের নিয়তি।
শুরু হলো মরুভূমির মধ্যে তাঁবুতে বসবাস। সেখানে থাকতে হলো প্রায় দেড় মাস। পরে বিভিন্ন জায়গায় কাটিয়েছি আরও আট থেকে নয় মাস। সে যে কী দুঃসময়, ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বৈরী আবহাওয়া, বিরূপ পরিবেশ, শত্রুসঙ্গ আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সবকিছুই আমাদের প্রতিকূলে। অথই পাথারে যেন কূল হারিয়েছি। এই অবস্থা থেকে যেন আর নিষ্কৃতি নেই। বেঁচে আছি জীবন্মৃতের মতো। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া ছাড়া বাকি সবই মৃতের মতো। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বা পরিবারের আর সবাই কে কেমন আছে, কিছুই জানি না। তারাও জানে না আমি কেমন আছি। হয়তো শুধু জানে, আমি বেঁচে আছি। ব্যস, এটুকুই।
অপহরণকারীদের অর্থসংকটের কারণে এখানকার পাটও গুটাতে হলো। তারা ক্রমেই আর্থিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। তাদের পক্ষে আমাদের পাঁচজন জিম্মিসহ দুটি ভিন্ন স্থানে অবস্থান করা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।
একপর্যায়ে তারা আবার আমাদের নিয়ে গেল সেই প্রথম জায়গায়, রুস্টারে। সবকিছু আগেরই মতো, তবে ব্যতিক্রম হলো আমার দলের অন্য দুজনকেও এবার তারা এখানে নিয়ে এসেছে। আমার গাড়িচালক খালেদ আর স্থানীয় নিরাপত্তা সহকারী (এলএসএ) বাকিল মাহদী আমাদের দেখে আনন্দে কাঁদতে শুরু করল। আমি ওদের সান্ত্বনা দিলাম, ধৈর্য ধরতে বললাম। আমি এইটুকু আশ্বস্ত বোধ করলাম যে এখন থেকে আমরা পাঁচজনই হয়তো এক জায়গায় থাকব। তবে আমাদের মুক্তির কোনো লক্ষণ দেখতে পেলাম না।
কয়েক দিন পর অপহরণকারীদের মধ্য থেকে নেতা গোছের একজন এসে আমার এলএসএ মাজেনের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথাবার্তা বলল। মাজেন পরে আমাকে জানাল, তারা আরেকটা বিশেষ ভিডিও বার্তা তৈরি করতে চায়। সেটা দিয়ে আল-কায়েদার আরব উপদ্বীপ শাখা আমাদের অপহরণের দায়িত্ব স্বীকার করে বিশ্বজুড়ে খুব জোরালো বার্তা প্রচার করতে করবে; সে বার্তায় আমাদের মুক্তির শর্তাবলি এবং দাবিদাওয়া পেশ করবে। তারা মনে করছে, আগের ভিডিও বার্তার কোনোটাই খুব কাজে আসেনি। আমি জানালাম, আমরা এটা করতে প্রস্তুত।
সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই তারা ল্যাপটপ, ক্যামেরা, স্ক্রিন, লাইট ইত্যাদি নিয়ে হাজির হলো। প্রায় দুই ঘণ্টা কাজ করে ভিডিও বার্তা তৈরি করা হলো। তারা ভাবল, এবার তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হবে। আমাদের মুক্তির বিষয়টি বাস্তবায়িত হবে। আমরাও এবার বেশ আশাবাদী হয়ে উঠলাম।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে ভিডিও বার্তাটি তৈরি করে সেপ্টেম্বরেই সেটি প্রচার করা হয়। জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের খবর অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স ভিডিওটি পেয়ে সারা বিশ্বের প্রচারমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ওই ভিডিও বার্তা দেখে আমার পরিবার প্রথমবারের মতো নিশ্চিতভাবে জানতে পারে, আমি বেঁচে আছি। আমার পরিবার আর একজন কোর্সমেট সেই ভিডিও বার্তার ভিত্তিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাকে উদ্ধার করার আবেদন জানায়। সরকার সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়ে আমার উদ্ধারকাজে তৎপর হয়। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। তারপরও আমাদের উদ্ধার করতে নয় থেকে দশ মাস লেগে যায়।
আমাদের রুস্টারে নিয়ে আসার কয়েক সপ্তাহ পর এলাকাটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে শুরু করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের যৌথ নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযান চালাতে শুরু করে। এতে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তারা আমাদের আরও উত্তরে মরুভূমির ভেতরে নিয়ে যায়। এবার আমার সহযাত্রী এক ইয়েমেনিসহ আমাকে অন্য এক শহরের একটি বাসায় তোলে। আমার অন্য তিন সঙ্গীকে মরুভূমির তাঁবুতেই আটকে রাখে।
আমাকে যে বাসায় রাখা হলো, সেটার পরিবেশ কিছুটা উন্নত ছিল। ভালো বিছানা, সোফা, এয়ারকন্ডিশনার, টেলিভিশন প্রভৃতি ছিল সেখানে। এসব দেখে আমার এই প্রথম মনে হতে লাগল যে আমাদের ভাগ্যে ভালো কিছু ঘটতে যাচ্ছে। পরে অবশ্য বুঝলাম, আমি ভুল বুঝেছি।
এখানে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলতে হতো। আমার তো ইংরেজিতে কথা বলা একদম নিষেধ। তা ছাড়া আমাকে বিছানায় ঘুমাতে দেওয়া হলো না, বরাদ্দ হলো সোফা। বিছানা দখল করল অপহরণকারী দলের সদস্যরা, যারা আমাদের পাহারায় নিযুক্ত ছিল। বাসাটির আরাম-আয়েশের উপকরণগুলো তারাই ব্যবহার করত, আমাদের কপালে জুটত উচ্ছিষ্ট। ওই বাসায় যে দুই মাস ছিলাম, তার পুরোটা সময় একই ঘরে দুজন সশস্ত্র সন্ত্রাসীর সঙ্গে থাকতে হয়েছে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্লিপিং উইথ দ্য এনিমি’। সেটা ছিল ভীষণ উদ্বেগজনক ও পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা।
একদিন আমাদের প্রহরীরা আবার এক ভিডিও বার্তা তৈরির তোড়জোড় শুরু করল। তাদের তো জাতিসংঘকে প্রমাণসহ জানাতে হবে যে আমরা এখনো বেঁচে আছি। নইলে দাবি আদায় হবে কীভাবে? সেই ‘প্রুফ অব লাইফ’-এর জন্য তড়িঘড়ি করে ভিডিও বার্তা তৈরি করা হলো। আমাদের বলা হলো, এবারের উদ্যোগ সফল হলে আমরা দ্রুত মুক্তি পাব।
এর পরপরই আমাদের আবার স্থানান্তর করে মরুভূমির সেই তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আমার অন্য তিন সঙ্গীকে আটকে রাখা হয়েছিল। সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করার উদ্দেশ্য ছিল, তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হলে সবাইকে যেন একই জায়গা থেকে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায়। আমি ওই তাঁবুতে যাওয়ার পর সতীর্থদের মুখেও একই কথা শুনতে পেলাম: আমাদের মুক্তি আসন্ন।