‘আশি বছর, অনেক দীর্ঘ সময়। পেছনে তাকালে দেখি শুধু শিল্পী হিসেবে নয়, অনেক কিছুর সঙ্গে স্বেচ্ছায় বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জড়িয়ে, মিলেমিশে থেকে সময়টা পার করলাম। এতে আনন্দ আছে, গর্বও আছে। জানি সামনের জীবন এত দীর্ঘ হবে না। অনেক কাজ করার ইচ্ছে আছে, কিন্তু করা হয়ে উঠবে না।’ আনন্দের সঙ্গে বাঁচার কথা বললেও একটু আক্ষেপের বিষণ্নতার রেশও ছুঁয়ে গেল ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবীর কণ্ঠে।
দেশের শিল্পকলা শুধু নয়, সংস্কৃতিকে যাঁরা আপন অনন্য প্রতিভা স্পর্শে ঋদ্ধ করে চলেছেন, আলোকিত করেছেন সমকাল—রফিকুন নবী তাঁদের অন্যতম। অবিস্মরণীয় কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’–এর স্রষ্টা। বিদগ্ধজনেরা বলেছেন, চিত্রকলায় বিশেষ করে ছাপচিত্রের কাঠখোদাই মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশেই নতুন মাত্রা দিয়েছেন তিনি। একইভাবে চারকোলের পূর্ণাঙ্গ চিত্রকলা সৃজনেও তিনি অতুলনীয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অঙ্কনের উত্তরাধিকার নিয়ে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন অঙ্কন ও জলরঙের কাজে। চিত্রকলা ছাড়া কাজ করেছেন আরও বিভিন্ন মাধ্যমে। বিচিত্র বিষয়ে নিয়মিতই লেখালেখি করেন। তিনটি উপন্যাসসহ কিশোর উপন্যাস, ভ্রমণবৃত্তান্ত, সরস রচনা, শিল্প সমালোচনা, সমাজ বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ, শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, আত্মজীবনী মিলিয়ে ২০টির বেশি গ্রন্থই বলে দেয় লেখকসত্তার সক্রিয়তার কথা।
বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী ‘রনবী’ নামেই তাঁর অনুরাগীদের কাছে পরিচিত। তাঁর ৮০তম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপনের জন্য আয়োজন করা হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচির।
আঁকাজোকা, লেখালেখির পাশাপাশি চারুকলার শিক্ষার্থীর জীবন থেকেই যুক্ত হয়েছেন দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে। পোস্টার এঁকেছেন, অংশ নিয়েছেন সাংগঠনিক কাজে। কর্মজীবনের শুরুতে সাংবাদিকতাও করেছেন। এ কারণেই গতকাল শনিবার জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শন কক্ষের সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন, বহু কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকার আনন্দের কথা। তাঁর ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এখানে আয়োজিত হয়েছে আনুপূর্বিক কাজের প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীর আজ রোববার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে। জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন কমিটি আয়োজিত এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন প্রধান অতিথি জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী ‘রনবী’ নামেই তাঁর অনুরাগীদের কাছে পরিচিত। তাঁর ৮০তম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপনের জন্য আয়োজন করা হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচির। সেসব তুলে ধরা হলো সংবাদ সম্মেলনে। রফিকুন নবীর কাজের বৈশিষ্ট্য নিয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন শিল্প সমালোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক। বক্তব্য দেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান, মাহফুজুর রহমান ও মাঈনুল আবেদিন। সঞ্চালনা করেন গ্যালারি চিত্রকের পরিচালক শিল্পী মনিরুজ্জামান।
জাদুঘরের প্রদর্শনীর জন্য বিভিন্ন সংগ্রাহকের কাছ থেকে শতাধিক শিল্পকর্ম সংগ্রহ করা হয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন মাধ্যমের ৯৬টি শিল্পকর্ম এখানে থাকবে। এগুলো বিক্রি হবে না।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন কমিটির আয়োজনে আজ একই সঙ্গে দুটি প্রদর্শনী হবে। জাদুঘরের প্রদর্শনীর জন্য বিভিন্ন সংগ্রাহকের কাছ থেকে শতাধিক শিল্পকর্ম সংগ্রহ করা হয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন মাধ্যমের ৯৬টি শিল্পকর্ম এখানে থাকবে। এগুলো বিক্রি হবে না। এ ছাড়া ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে সংগ্রাহকদের কিছু শিল্পকর্ম, শিল্পীর নিজের সংগ্রহে থাকা আগের এবং সম্প্রতি করা কাজ মিলিয়ে প্রায় ৬০টি শিল্পকর্ম নিয়ে দ্বিতীয় প্রদর্শনীটি একই সঙ্গে শুরু হবে। চিত্রকের প্রদর্শনীরও অধিকাংশ শিল্পকর্ম শুধুই প্রদর্শনীর জন্য, অল্প কিছু থাকবে বিক্রির জন্য।
২৮ নভেম্বর শিল্পীর জন্মদিনটি উৎসবমুখর করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিসার হোসেন জানালেন, চারুকলা অনুষদে এদিন বিকেল থেকে শুরু হবে জন্মদিনের উৎসব। এতে থাকবে রনবীর প্রায় ৯ হাজার কার্টুন, বইয়ের প্রচ্ছদ, পোস্টার নিয়ে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী। এ ছাড়া তাঁর কার্টুন সংগ্রহ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হবে চার খণ্ডের বই। উনসত্তুরে ছড়া নামে আরও একটি বই প্রকাশিত হবে। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এই ছড়ার সংকলনে তিনি অলংকরণ করেছিলেন। এতে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও রয়েছে। চারুকলার এই জন্মদিনের এই আয়োজন আর গ্যালারি চিত্রকের প্রদর্শনী চলবে আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে জাদুঘরের প্রদর্শনীটি শেষ হবে ৩০ নভেম্বর।
চারুকলা অনুষদে এদিন বিকেল থেকে শুরু হবে জন্মদিনের উৎসব। এতে থাকবে রনবীর প্রায় ৯ হাজার কার্টুন, বইয়ের প্রচ্ছদ, পোস্টার নিয়ে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী। এ ছাড়া তাঁর কার্টুন সংগ্রহ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হবে চার খণ্ডের বই। উনসত্তুরে ছড়া নামে আরও একটি বই প্রকাশিত হবে।চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন
গতকাল দুপুরের মধ্যেই দেয়ালে ছবি ঝোলানোর কাজ শেষ হয়েছিল। জাদুঘরের প্রদর্শনীটি শুরু শিল্পীর সংগ্রহের ১৯৫৭ সালে পেনসিলে আঁকা ‘কেশবিন্যাস’ নামের একটি শিল্পকর্ম দিয়ে। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। এর পরের কাজটি ১৯৬১ সালের, জলরঙে আঁকা বরেন্দ্রভূমির দৃশ্য, শিক্ষার্থীদের অনুশীলনমূলক কাজ। জলরঙে আরও আছে মাছরাঙা পাখি, সুন্দরবনের ঘাট, গ্রামের বাঁশের সাঁকো। চারকোলে আঁকা মহিষ, গরুর পাল নিয়ে রাখাল, রেলগাড়ি। বহুরাঙা বড় আকারের কাঠখোদাইয়ে আছে কবুতর, ঝড়ের নিসর্গ, মোরগ—এমন অনেক কাজ। তেলরং ও অ্যাক্রিলিকের কাজগুলো আকারে যেমন অনেক বড়, তেমনি অনেক মানুষের বিভিন্ন সমাবেশ ঘটেছে তাতে। বিভিন্ন ভঙ্গিতে বসে বা শুয়ে থাকায় দেহাবয়ব ও অভিব্যক্তির বৈচিত্র্যময় রূপ ফুটে উঠেছে এতে। ব্যস্ত রেলস্টেশন, লঞ্চের যাত্রীঠাসা ডেক, ছিন্নমূলদের ফুটপাতে গাদাগাদি করে বসবাস আর টোকাই তো আছেই। আরও আছে পারিবারিক মুহূর্তের কিছু দৃশ্য। মায়ের কোলে থাকা সন্তানের অপত্যস্নেহের সূচিস্নিগ্ধ ছবি। যূথবদ্ধ জীবন ও প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই বিভিন্নভাবে ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর কাজে। এসেছে বাংলার প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। শিল্পের অমল আলোয় তিনি পরিস্ফুটিত করে তুলেছেন এই জনপদের স্বরূপ ও জনসাধারণের মর্মস্পর্শী জীবনসংগ্রাম।
রফিকুন নবী অশীতিপর হতে চলেছেন, কিন্তু এখনো সক্রিয় তরুণের মতোই। গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন তো আমি সিনিয়র সিটিজেন। অবসর নেওয়ার বয়স। কিন্তু ভাবনা থেমে থাকে না। চারপাশের নানা ঘটনা মনে অনেক রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আঁকতে বসে যাই।’ আরও বলেন, ‘এটা অনেকটা রিলে রেসের মতো। শিল্পাচার্য তাঁর উত্তরাধিকার আমাদের হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। এখন আমাদের অনুজদের হাতে সেই উত্তরাধিকার দিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই এই পরম্পরা নতুনদের হাতে তৈরি করবে নতুন ইতিহাস।’
এখন তো আমি সিনিয়র সিটিজেন। অবসর নেওয়ার বয়স। কিন্তু ভাবনা থেমে থাকে না। চারপাশের নানা ঘটনা মনে অনেক রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আঁকতে বসে যাই।রফিকুন নবী