‘সারা পৃথিবীতে প্রাণঘাতী ক্যানসারগুলোর মধ্যে ফুসফুস ক্যানসার শীর্ষে। বাংলাদেশেও এ ধরনের ক্যানসারের প্রকোপ রয়েছে, যা দেশের মোট ক্যানসারে আক্রান্তের ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ। ক্যানসারবিষয়ক গবেষণা সংস্থা গ্লোবোক্যানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে পৃথিবীতে ২২ লাখ মানুষ ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ১৭ লাখ। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে পাঁচ হাজার মানুষ মারা যায়।’ এ কথা বলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান।
নভেম্বর মাস ফুসফুস ক্যানসার নিয়ে সচেতনতার মাস। এ উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলজি আয়োজন করে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। এ আয়োজনে অতিথি ছিলেন ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান। ফুসফুস ক্যানসার কেন হয়, কীভাবে নির্ণয় করতে হয়, বাংলাদেশে এর চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে উপস্থাপকের বিভিন্ন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে পরামর্শ দেন তিনি। গত ২০ নভেম্বর পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজে। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন নাসিহা তাহসিন।
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান বলেন, ফুসফুসে ক্যানসারের ঝুঁকি সাধারণত নারীদের তুলনায় পুরুষদের বেশি। ধূমপান, বায়ুদূষণ, রেডিয়েশন এক্সপোজার যদি থাকে এবং বংশগত কারণে ফুসফুস ক্যানসার হতে পারে। তবে প্রধান কারণ হচ্ছে ধূমপান।
ফুসফুস ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান বলেন, সাধারণ লক্ষণগুলো হলো ধূমপায়ীর দীর্ঘদিন কাশি হওয়া, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, শরীরের ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধামান্দ্য হওয়া, বুকে ব্যথা করা ইত্যাদি। লক্ষণের ওপরও অনেক সময় নির্ভর করে টিউমারটা শরীরে কতটুকু ছড়িয়েছে। তাই এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
এ পর্যায়ে উপস্থাপক জানতে চান, কেন ফুসফুস ক্যানসার নারীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি হয়? উত্তরে ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান বলেন, প্রধান কারণ হলো, পুরুষদের তুলনায় নারীরা ধূমপান কম করেন। তবে আরেকটা কারণ হতে পারে, পুরুষরা সাধারণত ঘরের বাইরে থাকেন। তাই বায়ুদূষণের মাধ্যমেও ফুসফুসে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ফুসফুস ক্যানসারের জন্য খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব সম্পর্কে ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান বলেন, খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে এখনো পর্যন্ত ফুসফুস ক্যানসার হওয়ার সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। তবে অ্যান্টি–অক্সিডেন্টজাতীয় এবং পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার খেলে যেকোনো ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
ফুসফুস ক্যানসারের স্ক্রিনিং প্রসঙ্গে ক্যানসারবিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রথমে মনে রাখতে হবে, কারও যদি বংশগত এ ধরনের ক্যানসার থাকে তখন দেখতে হবে পূর্বসূরিদের সর্বনিম্ন কোন বয়সে ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে। সেই বয়স হওয়ার ১০ বছর আগ থেকেই পুরুষ ও নারীর স্ক্রিনিং করতে হবে। আর ধূমপায়ী, বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাসকারী এবং লাকড়ির চুলায় রান্না করেন যাঁরা, তাঁদের ৪০ বছর বয়স থেকেই স্ক্রিনিং করা উচিত। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ফুসফুস ক্যানসার শনাক্তকরণে এখনো কোনো প্রোগ্রাম হয়নি। তবে ‘লোডোজ সিটি স্ক্যান’–এর মাধ্যমে ফুসফুস ক্যানসার নির্ণয় করা যায়।
এরপর উপস্থাপক ফুসফুস ক্যানসারের ধাপ এবং চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান বলেন, ‘স্টেজিং বা ধাপের ওপরই চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। ধাপগুলো হলো—স্টেজ ওয়ান, স্টেজ টু, স্টেজ থ্রি–এ, স্টেজ থ্রি–বি ও স্টেজ ফোর। সুতরাং স্টেজ নির্ধারণের পরই চিকিৎসা শুরু করতে হবে। স্টেজ–ওয়ান ও টু থাকলে সাধারণত আমরা সার্জারি করতে বলি। এ ছাড়া অ্যাডভান্স স্টেজে থাকলে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি এবং অবস্থাভেদে ইমিউনোথেরাপিও দেওয়া যায়।’
ফুসফুসে ক্যানসারের ক্ষেত্রে মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিউমার বোর্ডের ভূমিকা সম্পর্কে ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান বলেন, এটার গুরুত্ব অনেক। যেখানে একজন মেডিকেল অনকোলজিস্ট, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, সার্জনসহ প্রয়োজনে আরও বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে বোর্ড গঠিত হয়। তাঁরা মূলত ঠিক করবেন রোগীর চিকিৎসাটা কোন পদ্ধতিতে হবে। বাংলাদেশেও এ ধরনের বোর্ড রয়েছে।
ফুসফুস ক্যানসারের ধরন সম্পর্কে ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান বলেন, প্রথমটি অক্ষুদ্র কোষের ফুসফুসের ক্যানসার। এটি স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা, অ্যাডেনোকার্সিনোমা বা বড় সেল কার্সিনোমা হতে পারে। দ্বিতীয়টি ছোট কোষের ফুসফুসের ক্যানসার। এটি খুব সাধারণ ধরনের নয়, তবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তৃতীয়টি ফুসফুসের কার্সিনয়েড টিউমার। এটি একটি বিরল ধরনের ক্যানসার, যা নিউরোঅ্যান্ডোক্রাইন কোষকে প্রভাবিত করে।
ফুসফুস ক্যানসার নির্ণয়ের পর ভালোভাবে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ দেন ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান। তিনি বলেন, সাধারণত রোগীরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। এটা না করে যেকোনো ধরনের চিকিৎসার আগে অবশ্যই মেডিকেল অনকোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলা উচিত। প্রয়োজনবোধে একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি বোর্ডের পরামর্শ নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের ওপর বিশ্বাস আর সম্মিলিত চিকিৎসাপদ্ধতিতে রোগী ফুসফুস ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারবেন।
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।
ফুসফুস ক্যানসার মানেই কি মৃত্যু? উত্তরে ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান বলেন, ফুসফুস ক্যানসার নির্ণয় মানেই মৃত্যু নয়। ক্যানসার শব্দটা শুনলেই সবার মনে একধরনের ভীতির সৃষ্টি হয়। তাই ক্যানসার মানেই মৃত্যু—এ ধারণাটা প্রচলিত আছে। অথচ প্যারালাইজড, স্ট্রোক, কিডনি রোগসহ এমন অনেক রোগ আছে যেগুলো ক্যানসারের চেয়েও ভয়াবহ। সুতরাং এটা নিয় ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, বাংলাদেশে এখন ফুসফুস ক্যানসার নিরাময়ে বিশ্বমানের চিকিৎসাপদ্ধতি, চিকিৎসক ও ওষুধ রয়েছে।