শিশুদের চোখের স্বাস্থ্য, তথা দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে বাড়তি প্রযত্নের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন চক্ষুবিশেষজ্ঞরা। গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সেমিনারকক্ষে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় তাঁরা এ অভিমত দেন। চক্ষুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা সাইটসেভার্স এ গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।
আজ ১০ অক্টোবর বিশ্ব চক্ষু দিবস। প্রতিবছরের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার দিবসটি পালিত হয়। এ উপলক্ষেই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়। এ বছর বিশ্ব চক্ষু দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আপনার চোখকে ভালোবাসুন, শিশুর চোখের যত্ন নিন’। এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই গোলটেবিলের আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘স্বাস্থ্য খাতে চক্ষুসেবা নিশ্চিতকরণ: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’। গোলটেবিলে দেশের বিশিষ্ট চক্ষুবিশেষজ্ঞ, চোখ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
বিশেষ আলোচক হিসেবে আইএপিবি বাংলাদেশ অধ্যায়ের চেয়ারপারসন এবং ওএসবির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশের চক্ষু চিকিৎসাসেবার অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে দেশে ৩০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে প্রথম চক্ষু জরিপ হয়েছিল ২০০৩ সালে, তখন মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ ছিলেন দৃষ্টিশক্তিহীন। সর্বশেষ ২০২০ সালের জরিপে দেখা গেছে, এই বয়সের জনসংখ্যার মধ্যে দৃষ্টিহীনের সংখ্যা কমে ১ শতাংশে নেমেছে। এখন প্রতি ১০ হাজারে দৃষ্টিহীনের সংখ্যা ৬–এর কম। তবে এতে আত্মতুষ্টির কারণ নেই। অনেক ক্ষেত্রে অসাম্যতা রয়েছে। যথাযথ চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে দৃষ্টিহীনের সংখ্যা আরও কমিয়ে আনা সম্ভব।
অধ্যাপক এনায়েত হোসেন বলেন, চক্ষু চিকিৎসার বিষয়টিকে কেবল স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সেবা খাতের সঙ্গে যুক্ত করলে হবে না। একে উন্নয়নের সঙ্গে সমন্বিত করে বিবেচনা করার সময় এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণায় এটা প্রতীয়মান হয়েছে, দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকলে উৎপাদন তথা সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ অগ্রগতি অর্জিত হয়। এখন চক্ষুস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল স্রোতোধারায় সমন্বিত করে নীতিপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিশুদের চক্ষুস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় বিশেষ প্রযত্ন নিতে হবে।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একাডেমিক কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবদুল কাদের বলেন, চক্ষুস্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। চক্ষু চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও এ–সংক্রান্ত প্রশিক্ষিত জনবলের স্বল্পতা একটি বড় বাধা। চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট চক্ষুবিশেষজ্ঞ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। তাদের লক্ষ্য বছরে ২৫ থেকে ৩০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করা। তবে অর্থের স্বল্পতা রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক কাদের বলেন, যাঁরা দীর্ঘ সময় কম্পিউটার মনিটরসহ বিভিন্ন মাধ্যমের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকেন, তাঁদের প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর ১৫ মিনিট দৃষ্টিকে বিশ্রাম দিতে হবে। এমনকি যেসব শিশু অনলাইনে পাঠ গ্রহণ করে, চক্ষুস্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য তাদেরও এ নিয়ম মেনে চলা উচিত।
বেসরকারি সংস্থা সাইটসেভার্সের এ দেশের পরিচালক অমৃতা রেজিনা রোজারিও বলেন, ৫০ বছর ধরে তাঁদের প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে জনসাধারণের চক্ষুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে তাঁরা স্কুল পর্যায়ের শিশুদের চোখ পরীক্ষা, বিভিন্ন এলাকায় রোগীদের হাসপাতালে এসে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা, ১৬টি জেলায় সরকারি হাসপাতালে চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য অস্ত্রপচারকক্ষ স্থাপনসহ বিভিন্ন সহায়তা দিয়েছেন। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য চক্ষুসেবাদানে তাঁদের বিশেষ কার্যক্রম রয়েছে।
অমৃতা রোজারিও আরও বলেন, তাঁরা সম্প্রতি তাঁদের কাজের পরিধি আরও বিস্তৃত করেছেন। ডায়াবেটিক রোগীদের দৃষ্টি সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন। এ জন্য তাঁরা ডায়াবেটিক সমিতি ও সরকারের সঙ্গেও যৌথ উদ্যোগে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছেন।
বেসরকারি সংস্থা অরবিস ইন্টারন্যাশনালের এ দেশের পরিচালক ডা. মুনির আহমেদ বলেন, শিশুদের জন্য চক্ষুস্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দৃষ্টিতে সমস্যা থাকলে বৃদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক উৎকর্ষ অর্জনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হতে পারে। এ জন্য শিশুদের চক্ষুস্বাস্থ্যের সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য স্কুল পর্যায়ে শিশুদের নিয়মিত চোখ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ জন্য সরকারের নীতিকৌশল প্রণয়নকালে এটি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য বিভাগের খুলনার বিভাগীয় পরিচালক চিকিৎসক মো. মনজুরুল মুরশিদ বলেন, সারা দেশেই হাসপাতালগুলোতে চক্ষুবিশেষজ্ঞদের ব্যাপক স্বল্পতা রয়েছে। এ কারণে সরকারি হাসপাতাল থেকে জনসাধারণকে পর্যাপ্ত চক্ষুস্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায় না। তাঁর নিজের বিভাগের দৃষ্টান্ত দিয়ে জানান, ১০ জেলার মধ্যে ৬টি জেলার হাসপাতালে কোনো চক্ষুবিশেষজ্ঞ নেই। উপজেলা পর্যায়ে অবস্থা আরও নেতিবাচক। ফলে চক্ষুস্বাস্থ্য নিয়ে সরকারি কোনো কর্মসূচি থাকলেও লোকবলের স্বল্পতার কারণে মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়িত হয় না।
গোপালগঞ্জের এসএফএম চক্ষু হাসপাতাল অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাহিদ ফেরদৌসী বলেন, তাঁদের এই বিশেষায়িত হাসপাতালে ২০১৬ সালে সেবাদান শুরু হয়েছে। তিনি চক্ষুস্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য সঠিকভাবে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে একটি চিকিৎসাসহায়িকা তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক জয়ীতা তালুকদার বলেন, শিশুদের এখন বিনোদন ছাড়াও পড়ালেখার জন্য দীর্ঘ সময় অনস্ক্রিনে থাকতে হচ্ছে। এটা তাদের চক্ষুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে। তবে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে যেন শিশুরা টানা দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে না থাকে।
বেসরকারি সংস্থা ক্লিয়ার ভিশন কালেকটিভের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এনজিওগুলোর ভূমিকার কারণে চক্ষুস্বাস্থ্যসেবা দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সম্প্রসারিত হয়েছে।
ময়মনসিংহের ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের কো-অর্ডিনেটর পরাগ শরীফুজ্জামান বলেন, জাতীয় পর্যায়ে অনেক নীতিমালা গ্রহণ করা হয় কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়িত হয় না।
দৃষ্টিহীনদের প্রতিষ্ঠান ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুল হক বলেন, দৃষ্টিহীন হলে মানুষ অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
দ্য ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এ কে এম বদরুল হক বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে চক্ষু চিকিৎসাসেবা নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য তাঁদের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে।
সাইটসেভার্সের কো-অর্ডিনেটর খন্দকার সোহেল রানা বলেন, জাতীয় চক্ষু দিবসের কর্মসূচিতে চোখের গুরুত্ব তুলে ধরা হবে।
গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। তিনি বলেন, এই গোলটেবিলের লক্ষ্য চোখের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ সরকারি নীতিনির্ধারক পর্যায়ে তুলে ধরা।