বিজু, সাংগ্রাই, বিষুসহ পাহাড়ের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বর্ষবরণের উৎসব আর ঈদুল ফিতর এবার কাছাকাছি সময়ে পড়েছে। এ জন্য পাহাড়ে সব সম্প্রদায়ের মানুষের মনেই এখন উৎসবের আমেজ লেগেছে। শুরু হয়েছে কেনাকাটাও। ঈদ ও বৈসাবির নতুন পোশাকের খোঁজে তিন পার্বত্য জেলার বিপণিকেন্দ্রগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন ক্রেতারা। প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন।
ঈদ আর বৈসাবি কাছাকাছি সময়ে পড়ায় কেনাকাটার ধুম পড়েছে খাগড়াছড়ির শোরুমগুলোতে। ভিড় বাড়ছে বিজুর মেলাগুলোতেও। গ্রাম থেকে শহরে কেনাকাটা করতে আসছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ মনের মতো পোশাক বানাতে ছুটছেন দরজিবাড়ি। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই জমজমাট হয়ে উঠছে উৎসবের বাজার।
গত রোববার বিকেলে খাগড়াছড়ি বাজার ঘুরে দেখা যায়, তৈরি পোশাক সব নারীর পছন্দের তালিকায় থাকলেও থান কাপড়ের দোকানে পাহাড়ি তরুণীদের ভিড় বেশি ছিল। বাজারে সেলাই করা থ্রি-পিস পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকার মধ্যে। সেলাইবিহীন থ্রি-পিসের দাম ৪০০ থেকে ৮ হাজার টাকার মধ্যে। বৈসাবি ও ঈদের কেনাকাটার বাজারে সুতি ও নেট কাপড়ের প্রচুর চাহিদার পাশাপাশি লিনেন, জর্জেট, কাতান কাপড়ও ভালো বিক্রি হচ্ছে বলে জানান দোকানিরা। এসব কাপড় প্রতি গজ ৬০ টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
পানখাইয়াপাড়ায় এক কাপড়ের দোকানে কথা হয় মহালছড়ি থেকে আসা আনাই মারমা, চিংমেপ্রু মারমা, মিতালি মারমা ও নুনুপ্রু মারমার সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ১১ জন বান্ধবী মিলে প্রতিবছরের মতো এবারও সাংগ্রাই উৎসবে একই ডিজাইনের নেট আর সুতির গজ কাপড়ের থামি সেলাই করবেন। সকাল থেকে ছয় ঘণ্টা সারা বাজার ঘুরে বিকেলে পানখাইয়াপাড়ার এক দোকানে এসে তাঁরা পছন্দের কাপড় কিনেছেন। তাঁদের একই রঙের কাপড় মেলাতে যেমন কষ্ট হয়েছে, তেমনি দামও বেশি দিতে হয়েছে।
বাঘাইছড়ি থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছেন শিক্ষক রেশমি চাকমা। তিনি বলেন, কাপড় পছন্দ হচ্ছে, তবে দাম বেশি। বিশেষ করে বাচ্চাদের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে বাজেটের বাইরে চলে গেছে। অথচ এক মাস আগেও এমন দাম ছিল না। শোরুমগুলোরও একই অবস্থা।
খাগড়াছড়ি বাজারের শাড়ি, থ্রি-পিস ও থান কাপড়ের দোকান আমন্ত্রণ ক্লথ স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. শাহ আলম বলেন, ‘সারা বছর বৈসাবি আর ঈদের অপেক্ষায় থাকি। সারা বছরের বিক্রি এই দুই উৎসবে হয়ে থাকে। থ্রি-পিসের চেয়ে থান কাপড় বিক্রি হচ্ছে বেশি। এখন পর্যন্ত পাহাড়ি ক্রেতার সংখ্যা বেশি। আশা করছি ৩ তারিখের পর ঈদ আর নববর্ষের বিক্রি বাড়বে।’
শহরের কুমিল্লাটিলা এলাকার নাসিমা আক্তার নামের এক গৃহবধূ সন্তানদের নিয়ে বাজার করতে এসেছেন সেলিম মার্কেটে। তিনি একই কথা বলেন, ‘আগের তুলনায় পোশাকের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ তবে পোশাকের মান বাড়েনি। তবু সবার জন্য নতুন পোশাক নিচ্ছি দামাদামি করে।’
রাঙামাটিতে ঈদ ও বৈসাবি উপলক্ষে বিপণিকেন্দ্রগুলোতে ভিড় বাড়ছে। বিপণিকেন্দ্র বা পোশাকের দোকানের পাশাপাশি বৈসাবি উপলক্ষে আয়োজিত মেলায়ও ক্রেতারা ভিড় করছেন। শাড়ি, থ্রি-পিসের সঙ্গে কিনছেন পিনন-হাদিও।
১২ এপ্রিল বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিহু, বিষু ও সাংক্রান শুরু হবে। এদিকে ঈদ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ১০ বা ১১ এপ্রিল। এই উপলক্ষে শহরের বাজারগুলোতে বিক্রি বাড়তে শুরু করেছে। তবে পাহাড়িদের উৎসব উপলক্ষে বেচাকেনার তুলনায় এখনো তেমন বিক্রি বাড়েনি বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। কাছাকাছি সময়ে ঈদ ও পাহাড়িদের উৎসব হওয়ায় ব্যবসা তেমন লাভজনক হবে না বলে মনে করছেন।
গত শনিবার সকালে বনরূপা বাজারে পিনোন-হাদি অস্থায়ী হাটে গিয়ে দেখা যায়, শত শত ক্রেতা-বিক্রেতা ভিড় করেছেন। অন্যান্য হাটের দিনের তুলনায় বেশ জমে উঠেছে।
শহরের রিজার্ভ বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী মো. আতিক উল্লাহ বলেন, ‘ঈদের বাজারে এখনো তেমন বিক্রি বাড়েনি। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় সামান্য কিছু বিক্রি বেড়েছে। আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যে বিক্রি আরও কিছু বাড়বে। ঈদের বাজার জমে উঠবে ৭ থেকে ৯ এপ্রিল।’
শহরের বনরূপার কাটাপাহাড় এলাকায় পুনং চান দোকানের মালিক রাজি চাকমা বলেন, অন্যান্য দিনের তুলনায় কয়েক দিন ধরে কিছু বিক্রি বেড়েছে। তবে আরও কিছুদিন পর আরও বিক্রি বাড়বে। তবে টি-শার্ট ও প্যান্টের বিক্রি বেড়েছে।
বান্দরবানের বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতার ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। ঈদ ও বৈসাবির কথা মাথায় রেখে দোকানে পোশাক উঠিয়েছেন বিক্রেতারা। গতকাল সোমবার বেতন-বোনাস পেয়ে চাকরিজীবীদের অনেকে বিপণিবিতানে পরিবার নিয়ে গেছেন কেনাকাটা করতে।
জেলা শহরের বিপণিবিতানগুলোতে নারী ও শিশুদের সংখ্যাই বেশি দেখা গেছে। তাঁরা বলেছেন, দোকানগুলোতে ভিড় বাড়ার আগে ছেলেমেয়েদের পরনের কাপড় কিনে দিতে এসেছেন। শহরের হক হিল মার্কেটে এসেছেন তাসলিমা আক্তার। তিনি বলেছেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে বেসামাল অবস্থা। ঈদে নিতান্ত যা না হলে নয় তা কেনার চেষ্টা করছেন।
দোকানি মোহাম্মদ রফিক, মোহাম্মদ নোমান বললেন, এবার তাঁরা ঈদ ও সাংগ্রাইং—দুই উৎসব বিবেচনায় নিয়ে পণ্য সংগ্রহ করেছেন। উৎসবের আরও ৯ থেকে ১০ দিন সময় আছে। এখন ক্রেতা আসতে শুরু করেছেন। চাকরিজীবীরা সবাই বেতন ও বোনাস পেলে ক্রেতার ভিড় আরও বেশি বাড়বে।
কেএসপ্রু মার্কেটের সবচেয়ে সমৃদ্ধ স্বপ্নপুরী দোকানের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম বলেছেন, কয়েক দিনে বিক্রি মোটামুটি বেড়েছে। তাঁদের কাছে ঈদ ও সংগ্রাইং উভয় উৎসবের সংগ্রহ রয়েছে। চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে বাজার বেশি জমবে।
বার্মিজ মার্কেটগুলোতেও পাহাড়িদের ভিড় বেড়েছে। মাস্টার বার্মিজের হ্লাসিংপ্রু মারমা জানালেন, সাংগ্রাইং বাজারের এখনো সময় আছে। আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে বাজারে ভিড় বাড়বে।
বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা চথুইপ্রু মারমা বলেছেন, এবার ঈদুল ফিতর, বিজু, সাংগ্রাইং ও পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ প্রায় একই সময়ে হচ্ছে। ঈদের ছুটি শুরু হবে ১০ এপ্রিল। চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরাদের বৈসুক ১২ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল।