চার শ বছরের পুরোনো শহর ঢাকা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়—কত উপলক্ষেই না থাকে নানা আয়োজন–উৎসব এই শহরে। আর প্রতিটি উৎসব ঘিরে রয়েছে রসনাবিলাসের বহু বিচিত্র আয়োজন। বইপত্র থেকে এবং ঢাকাবিষয়ক গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোগল আমল থেকেই ঢাকায় উৎসাহের সঙ্গে উদ্যাপিত হয়ে আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই ঈদে ঢাকাবাসীর ঘরে ঘরে তৈরি হয় নানা ধরনের উপাদেয় খাবার। নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের তৃপ্তির সঙ্গে আপ্যায়ন করানো ঢাকাবাসীর ঐতিহ্য।
এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকাই খাবার বই থেকে জানা যাচ্ছে, সেকালে ঈদের দিনের প্রধান খাবার ছিল মোরগ পোলাও। ‘পোলাও’ শব্দটি এসেছে তুর্কি শব্দ ‘পিলাও’ থেকে। কালক্রমে উচ্চারণ বদলে হয়েছে পোলাও। ঢাকার মোরগ পোলাওকে ‘খাস্বা পোলাও’ বলা হতো। ঢাকা পাচাস বারাস পাহেলে বইতে হাকিম হাবিবুর রহমান লিখেছেন, এটাই ছিল ঢাকার বিশেষ পোলাও। এতে আস্ত মোরগ রাখা হতো। এক সের চালে চারটা মোরগ, আধা সের ঘি, এক কাপ দুধের সর, পরিমাণমতো বাদাম, পেস্তা, কিশমিশ ও জাফরানের পেস্ট দেওয়া হতো।
সেই মোরগ পোলাও এখন আর নেই। কিন্তু সে স্বাদ একবার যাঁরা মুখে নিয়েছেন, তাঁরা তা ভুলতে পারেন না। ঢাকার সেই মোরগ পোলাও সম্পর্কে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাই শাহেদ সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করেছেন, ঢাকার মোরগ পোলাওর স্বাদ লিখে তুলে ধরা যায় না। সেটি একটি অভিজ্ঞতা, সে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। (ষাট বছর আগের ঢাকা; সৈয়দ আলী আহসান, বাতায়ন প্রকাশন)
সেকালে ঢাকায় ঈদের দিনে তৈরি করা হতো নানা পদের মিষ্টান্ন। এর মধ্যে একটি ছিল চুটকি সেমাই। হাতে পাকানো এ সেমাই তৈরি করা হতো রোজার মাসব্যাপী। এরপর শুকিয়ে রাখা হতো। ঈদের চাঁদ দেখার পরপরই গরম পানিতে ধুয়ে ঘন দুধে রান্না করা হতো। এতে দেওয়া হতো কিশমিশ ও পেস্তাবাদাম।
ঢাকাবাসী ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে দুধে ভিজিয়ে রাখা খোরমা খেতেন, যার নাম ছিল ‘শির খোরমা’।
সেকালে ঈদের দিনে যেসব খাবার রান্না হতো, তার অনেক কিছু এখনো বনেদি বাড়িতে টিকে আছে। পরিবর্তন এসেছে রন্ধনপ্রণালিতে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও নতুন পদ যুক্ত হয়েছে ঈদের খাবারের তালিকায়।
এখনো পুরান ঢাকাবাসী ঈদের দিনে যেসব খাবার খেয়ে থাকেন, সে সম্পর্কে ঢাকাই খাবার বইয়ের ‘ঢাকার ধর্মীয় উৎসবের খাবার’ অধ্যায়ে গবেষক রফিকুল ইসলাম রফিক কয়েকটি পদের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধে৵ রয়েছে দুধ সেমাই, ফিরনি, চালের সেমাইয়ের জর্দা, লাচ্ছা সেমাই, মোরগ পোলাও ও বিরিয়ানি, সাদা পোলাও, মাংস, খিচুড়ি, লাড্ডু বা মিষ্টান্ন। তিনি লিখেছেন, এসবই একটু পরিমাণমতো বেশি রান্না করা হতো, যাতে আত্মীয়, পাড়াপ্রতিবেশীদের বেশি করে খাওয়ানো যায়।
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে ঈদের দিনে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে কী ধরনের খাবারের আয়োজন করা হতো, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ‘ঢাকায় প্রথম ঈদের স্মৃতি’ লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন, সে পরিবারে ঈদের দিনে আয়োজন করা হয়েছিল পোলাও, কোরমা, মুসাল্লাম, কোপ্তা, সেমাই, পরোটা, নিমকি ও শিঙাড়া।
এখন অবশ্য ঈদের দিনে পুরান ঢাকার অনেক পরিবারে কাস্টার্ড, পুডিং, নুডলস, চটপটি ও হালিম করা হয়। অনেক পরিবারে আবার সকালে খিচুড়ি খাওয়ার চল রয়েছে। দুপুরে পোলাও। সবাই কমবেশি তাঁর সাধ্যমতো দিনের শ্রেষ্ঠ খাবারটাই পরিবারের জন্য আয়োজনের চেষ্টা করেন।
ঢাকার বনেদি পরিবারের সন্তান ও ঢাকাবিষয়ক একাধিক গ্রন্থের লেখক সাদ উর রহমান জানান, ঈদের দিনে তাঁদের বাড়িতে সকালে দুধসেমাই, জর্দাসেমাই খেয়ে ঈদের জামাতে যাওয়া হতো। সেটি অবশ্যই খাঁটি দুধমালাই, বাদাম তবক দিয়ে পরিবেশন করা হতো। সঙ্গে থাকত জাফরানি পেস্তাবাদাম শরবত। এ ছাড়া মাঝেমধে৵ মাকুতি (একধরনের ফিরনি) তৈরি হতো কখনো কখনো।
প্রথম আলোকে সাদ উর রহমান বললেন, ‘নামাজ শেষে এখনো পরিবারের সবাই একসঙ্গে সকালে মোরগ পোলাও খাওয়া হয়। সঙ্গে শামি কাবাব, বোরহানি ও আলুবোখারার চাটনি। আগে বিকেলে বাসায় তৈরি হতো লাচ্ছা সেমাই, ফালুদা, প্যাঁচ পরোটা, নারগেসি কোফতা বা বিফ কোফতা। রাতে মোরগ পোলাও চলত। কখনো অতিথিদের জন্য মোরগ মোসাল্লম, কালিয়ার ব্যবস্থাও করা হতো। চুটকি সেমাই তৈরি হতো পরের দিন। গরমের দিনে দুধ ছাড়াও কয়েক পদের বাহারি ফলের শরবত তৈরি করতেন আমাদের মা–দাদিরা।’
জানা গেল, ঈদের পরবর্তী দিনে বাসি কালিয়া ও সাদা পোলাওয়ের খুব চল ছিল পুরান ঢাকায় পরিবারগুলোতে। এখনো যা বর্তমান।
খাবার পরিবেশন ও অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে প্রথম আলোকে জানান পুরান ঢাকার আরেক বনেদি পরিবারের সন্তান, ভাষা আন্দোলন স্মৃতি রক্ষা পরিষদের সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন আহাম্মদ। তাঁর মতে, পরিবারের সবাই বড় একটা ঘরে ফরাশ বা শতরঞ্জি বিছিয়ে একসঙ্গে খাবার গ্রহণ করাই ছিল রীতি। অন্তত সকালের ঈদের নামাজ–পরবর্তী খাবারটা এভাবে খাওয়া হতো। মেহমানদের জন্য আলাদা কিছু তৈরি হতো না। বাড়ির সবার জন্য যে রান্না, সেটিই মেহমানদের পরিবেশন করা হতো।