চন্দনা টিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায়
চন্দনা টিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায়

পাখি

বনের চন্দনা টিয়া এখন ঢাকায়

প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। ভোরে পাখি কলরব, বিশুদ্ধ বাতাস, ফুলের সুবাস—এসবের মধ্য দিয়েই সকালটা কেটে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমার বসবাসের সুবাদে প্রাকৃতিক পরিবেশের কিছুটা হলেও আমেজ পাওয়া যায়। কারণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবাসিক এলাকা ও পার্কগুলোতে বেশ কিছু বড় গাছ এখনো টিকিয়ে রেখেছে। আর যানবাহনের কোলাহল কিছুটা কম থাকায় পাখির আনাগোনা ও কলরব বেশ ভালোই থাকে।

বাসার বারান্দা থেকে মূলত বাংলা-ঠোকরা, কোকিল, সবুজ টিয়া, ভাতশালিকের দল, পাকরা শালিক, কাক, দোয়েল, লাল-পুচ্ছ বুলবুল, বেগুনি মৌটুসি, কালো মাথা বেনেবউ, দাগি বসন্তবাউরি—এগুলোকে প্রতিনিয়ত ডাকাডাকি করতে দেখা যায়। প্রতিদিনের মতো সেদিনও খুব সকালে ঘুম ভাঙল, তবে প্রতিদিনের পক্ষিকুল থেকে ভিন্ন কলরব অর্থাৎ একটি উচ্চ কণ্ঠের ধ্বনি ভেসে এল, যেন কিছুটা অপরিচিত মনে হলো। বিস্মিত হয়ে ছুটে গেলাম বাসার বারান্দায়। দেখলাম বারান্দা থেকে অনেকটা দূরেই কড়ইগাছের মাঝবরাবর একটি ডালে উচ্চ স্বরে একটি পাখি ডাকছে। ছেলেকে বললাম, ক্যামেরায় জুম লেন্সটি লাগিয়ে দ্রুত কয়েকটি ছবি তুলতে। পাখিটি ডালের এমন জায়গায় বসে ছিল যে বারান্দা থেকে ছবি তোলা খুবই দুষ্কর ছিল। তবু পাখিটি শনাক্তের জন্য দুটি ছবি সে তুলতে পেরেছিল।

ছবি দুটি ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, এরা মূলত ‘চন্দনা টিয়া’, যার ইংরেজি নাম অ্যালেক্সানড্রাইন প্যারাকিট, বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula eupatria। এটি এ দেশের সবচেয়ে বড় আকৃতির টিয়া পাখি। কিছুক্ষণ পর আরও একটি একই প্রজাতির পাখি উড়তে দেখে বুঝে গেলাম যে এর এক জোড়া এখানে এসেছে। দ্রুত আমার গবেষণা দলের সদস্য উজ্জ্বল দাসকে জানালাম এবং অনুসন্ধান করতে বললাম শেষবার কবে চন্দনা টিয়া ঢাকা শহরে দেখা গেছে! সে বলল কদাচিৎ ডাক শোনা যায়, কিন্তু ছবি তোলার সুযোগ হয়নি।

পাখিটির ইংরেজি নাম নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল জাগে। এই নামে একটা ইতিহাস লুকিয়ে আছে। চন্দনা টিয়ার ইংরেজি নামের সঙ্গে গ্রিসের ‘মহাবীর আলেকজান্ডার’-এর নাম জড়িয়ে আছে। তিনি বিখ্যাত এবং সম্মানিত ব্যক্তিদের রাজকীয় পুরস্কার বা প্রতীক হিসেবে চন্দনা টিয়া দেওয়ার প্রচলন করেছিলেন। আলেকজান্ডার চন্দনা টিয়াদের ভারতের পাঞ্জাব থেকে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে শুরু করে পৃথিবীর অনেক দেশে উপহার হিসেবে ছড়িয়ে দেন। তখন থেকে এই টিয়ার এই ইংরেজি নাম হয়।

বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি চন্দনা টিয়া, যা Psittaciformes বর্গের অন্তর্ভুক্ত এবং Psittaculidae পরিবারের মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম টিয়া পাখি। এরা শুষ্ক, পর্ণমোচী বন, আর্দ্র নিম্নভূমির বন, চাষ করা এলাকার আশপাশের গাছ, পুরোনো গাছের বাগান, ম্যানগ্রোভ ও বনভূমিতে বাস করে। ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের বাগানে ও লোকালয়ে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। এটির দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার আকার ও কাকের মতো এবং ওজন ২০০ থেকে ২৬০ গ্রাম। দেহ সবুজ, বুক ও পেট ফ্যাকাশে হলদে ভাব, সবুজ বিশাল লাল চঞ্চুর শেষ প্রান্তে কমলা দাগ। চোখ লেমন সবুজ, কাঁধে মেরুন পট্টি। লম্বা সবুজ লেজের কিছু অংশ নীল ও হলুদ। পুরুষের থুতনি ও গলা কালো এবং ঘাড়ে গোলাপি বলয় থাকে। পুরুষ চন্দনা টিয়ার ডাক বেশ গভীর এবং শক্তিশালী হয়, যা এক কিলোমিটার পর্যন্ত শোনা যায়।

চন্দনা টিয়া সাধারণত বসন্ত ও গ্রীষ্মে প্রজনন করে থাকে। এরা শুধু একজনের সঙ্গে জোড়া বাঁধে, যাকে আমরা ইংরেজিতে মনোগেমি বলি। এদের জুটিবন্ধন খুবই শক্তিশালী। এরা গাছের গহ্বরে বা কৃত্রিম বাক্সে বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। স্ত্রী পাখি ৩-৬টি ডিম দেয় এবং পুরুষ-স্ত্রী দুজনে মিলে ডিমে তা দেয়, ২৩-২৮ দিনের মধ্যে বাচ্চা ফোটায়।

মূলত এরা ফলভুক পাখি। বুনো ও চাষ করা ফল, বীজ, বাদাম, ফুল, ফুলের কুঁড়ি, অঙ্কুর, কোমল পাতা, শস্য, শাকসবজি খেয়ে থাকে। তা ছাড়া মা পাখিরা বাচ্চাদের ছোট ছোট পোকামাকড়ও খাওয়ায়। সুতরাং বলা যায়, এই প্রজাতির পাখির উপস্থিতি কোনো একটা এলাকার পরিবেশ কতটুকু গাছপালাসমৃদ্ধ এবং ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র, তার নির্দেশক হিসেবে কাজ করে।

পৃথিবীজুড়ে Psittaculidae পরিবারের বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বাসাবাড়িতে শৌখিন পাখি হিসেবে পোষা হয়ে থাকে। যেহেতু চন্দনা টিয়া পাখিটি আমদানি-রপ্তানি করা নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের বিভিন্ন পাখি বেচাকেনার হাটে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাখি ক্রয়-বিক্রয় গ্রুপে এদের ক্রয়-বিক্রয় করতে দেখা যায়, যা বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় এদের আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে প্রজনন বিঘ্নিত হচ্ছে, ফলে এ পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত নগরায়ণের কারণে এই প্রজাতির পাখিগুলো গভীর বনে এবং কোনো অভয়ারণ্য পর্যন্তই নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রেখেছে।

তাই শহরের গাছপালাসমৃদ্ধ এলাকাগুলো সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দেশের গভীর বনে বসবাসকারী প্রজাতির পাখিগুলো শহরাঞ্চলেও আবাসস্থল গড়ে তুলবে এবং দেশ জীববৈচিত্র্যে আরও সমৃদ্ধ হবে।

  • মোহাম্মদ ফিরোজ জামান: অধ্যাপক ও প্রাণী–গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়