ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন। তাঁর নামে উন্নয়নকর্মী নজরুল ইসলাম সন্তানের নাম রেখেছিলেন হো চি মিন ইসলাম। বাবার রাখা নামটা পরিবর্তন করেননি, তবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্তন প্রতিস্থাপন (ইমপ্ল্যান্ট) ও কৃত্রিমভাবে স্ত্রী প্রজননতন্ত্র তৈরি (ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি) করেছেন হো চি মিন ইসলাম। এখন তিনি ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত নারী।
হো চি মিন ইসলাম বললেন, ‘আমার শরীরটা পুরুষের ছিল, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমি নিজেকে নারী ভাবতাম। অবশেষে অস্ত্রোপচার করে পুরুষ থেকে নারী হয়েছি, গোপন করার কিছু নেই। এখন আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে একজন নারী।’
ভারতের দিল্লির অলমেকস প্রিমিয়ার ট্রান্সজেন্ডার সার্জারি ইনস্টিটিউটে অস্ত্রোপচার করেছেন হো চি মিন ইসলাম। ২৯ বছর বয়সী হো চি মিন জানান, চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল স্তনের অস্ত্রোপচার হয়। সাত দিন পর আরেক অস্ত্রোপচারে কৃত্রিমভাবে স্ত্রী প্রজননতন্ত্র তৈরি করা হয়। ৫ মে দেশে ফেরেন তিনি। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সিনিয়র স্টাফ নার্স হো চি মিন কাজে যোগ দেন ২০ মে। জটিল ওই অস্ত্রোপচার শেষে দেশে ফেরার পর তিনি এরই মধ্যে একবার নেপালও ঘুরে এসেছেন।
হো চি মিনের জন্ম বগুড়ায়। বাবা মারা গেছেন ২০১৩ সালে। মা ও এক বোন আছেন। একসময় তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকলেও এখন স্বাভাবিক। হো চি মিনকে তাঁরা মেনে নিয়েছেন। অস্ত্রোপচারের সময় মানসিকভাবে সাহস জুগিয়েছেন।
মে মাসের শেষ সপ্তাহে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে কথা হয় হো চি মিনের সঙ্গে। তিনি জানান, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দিল্লিতে সরকারিভাবে ট্রান্সজেন্ডারদের অস্ত্রোপচারের জন্য অনুমোদিত হাসপাতালে (অলমেকস প্রিমিয়ার ট্রান্সজেন্ডার সার্জারি ইনস্টিটিউট) তাঁর অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসক নরেন্দ্র কৌশিক। অস্ত্রোপচারের আগে দেড় ঘণ্টা চলে কাউন্সেলিং। হাসপাতালে থাকতে হয়েছে ১৮ দিন। খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা।
থাইল্যান্ডে এমন অস্ত্রোপচারে প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয় জানিয়ে হো চি মিন বলেন, এর আগে লেজার চিকিৎসা ঢাকাতেই করেছিলেন তিনি। আর হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়।
হো চি মিন বলেন, ‘ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট বা স্তন প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচারে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। অস্ত্রোপচারের পর আমার বমি শুরু হয়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। বুকে চাপ ধরে ছিল। নিজে নার্স, তাই পরিস্থিতি অনেকটাই বুঝতে পারছিলাম। অজ্ঞান হয়ে গেলে ভেন্টিলেশন, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ সবই লাগে। মরে গেলে মা, বোনকে কে দেখবে, সে চিন্তাও মনে এসেছিল। আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে স্ত্রী প্রজননতন্ত্র তৈরিতে সময় লাগে ছয় ঘণ্টা। তবে তখন আর আইসিইউ পর্যন্ত যেতে হয়নি।’
পশ্চিমবঙ্গের বাপ্পাদিত্য মুখার্জী ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন জানিয়ে হো চি মিন বলেন, ‘হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের পর তিনিই ছিলেন আমার অভিভাবক। সেখানে স্বজন বলতে তো আর কেউ ছিলেন না।’
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে কাজ করার আগে হো চি মিন ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়েই রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের নিবন্ধিত নার্স ছিলেন। দুই বছর কাজ করেছেন কার্ডিয়াক আইসিইউতে। ২০২১ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে জনস্বাস্থ্যের ওপরে মাস্টার্স করেন ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়েই।
হো চি মিনের জন্ম বগুড়ায়। বাবা মারা গেছেন ২০১৩ সালে। মা ও এক বোন আছেন। একসময় তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকলেও এখন স্বাভাবিক। হো চি মিনকে তাঁরা মেনে নিয়েছেন। অস্ত্রোপচারের সময় মানসিকভাবে সাহস জুগিয়েছেন। হো চি মিন ঢাকায় আসার পর তাঁর বাসায় মা এসে রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেন।
অস্ত্রোপচারের আগে নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করতে হয়েছে উল্লেখ করে হো চি মিন বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের আগে আমার শরীরটা ছিল পুরুষের। নিজের আইডেনটিটি বা পরিচিতির জন্য এবং নিরাপত্তার জন্যও অস্ত্রোপচার করাটা জরুরি ছিল। ইউটিউবে অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন ভিডিও দেওয়া আছে, তা দেখেছি। তবে এ নিয়ে ভালো গবেষণা নেই। জীবনের ঝুঁকি আছে, তা তো জানাই ছিল। ১০ লাখ টাকা জোগাড় করাটাও কঠিন ছিল। নিজের জমানো টাকার পাশাপাশি ঋণ করতে হয়েছে।’
আগে জিমে (শরীরচর্চাকেন্দ্র) গেলেও সেখানকার পোশাক পরতে পারতেন না জানিয়ে হো চি মিন বললেন, ‘আইডেনটিটি ক্রাইসিস (পরিচয়সংকট) তীব্র মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটা যাঁর হয়নি, তিনি কখনো বুঝতে পারবেন না। এখন আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে।’
দেশে ট্রান্সজেন্ডারদের অস্ত্রোপচারের জন্য সরকারিভাবে বা প্রকাশ্যে কোনো ব্যবস্থাপনা এখনো গড়ে ওঠেনি। অনেকে গোপনে নানা জায়গায় অস্ত্রোপচার করছেন। তবে হো চি মিন ঝুঁকি নিতে চাননি। তাই দিল্লিতে অস্ত্রোপচার করেছেন বলে জানালেন। তাঁর মতে, অনেক দেশেই সরকার ট্রান্সজেন্ডারদের স্বাস্থ্যের বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এ দিকে নজর দিলে বিদেশে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হতো না।
হো চি মিন বলেন, ‘ট্রান্সজেন্ডারদের মধ্যে অনেকেই অস্ত্রোপচারসংক্রান্ত তথ্য জানতে চান। তথ্য জানা না থাকার কারণে অনেকেই বিপদে পড়ছেন। তাই আমি আমার অস্ত্রোপচারের কথা গোপন করিনি।’
নিজে আইসিইউ থেকে ফিরেছেন। তাই আইসিইউতে থাকা রোগীর যন্ত্রণা এখন আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারছেন হো চি মিন। এ কারণে কাজে যোগ দেওয়ার পর নিজে নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছেন, দায়িত্ব পালনে কখনো একবিন্দু অবহেলা করবেন না।
অস্ত্রোপচারের পর কেমন অনুভূতি হয়েছিল জানতে চাইলে হো চি মিন বলেন, ‘চোখ খুলেই কান্না করেছি। এত দিন যে পরিচয়ে পরিচিত হতে চেয়েছি, তা হতে পেরেছি। তবে আয়নায় নিজেকে দেখে প্রথমে একটু মন খারাপ হয়। একদম নারীর মতো শরীর হয়নি তো! পরে চিকিৎসক জানান, অস্ত্রোপচারের পর তিন থেকে চার মাস অপেক্ষা করতে হবে নারীর মতো শারীরিক গঠন পেতে।’
আইডেনটিটি ক্রাইসিস (পরিচয়সংকট) তীব্র মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটা যাঁর হয়নি, তিনি কখনো বুঝতে পারবেন না। এখন আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে।হো চি মিন ইসলাম, রূপান্তরিত নারী
প্রথম আলো কার্যালয়ে গত মে মাসের ওই আলাপচারিতার পর গত বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে আবার কথা হয় হো চি মিনের সঙ্গে। জানালেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন। শারীরিক গঠনেও পরিবর্তন এসেছে। তবে ফলোআপের জন্য আবার তাঁকে দিল্লি যেতে হবে।
অস্ত্রোপচারের বিষয়টি হো চি মিন কখনো গোপন করেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দিল্লির হাসপাতাল থেকে নিজের ছবি ও শারীরিক অবস্থা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন।
হো চি মিন পরিবার ছেড়ে প্রথম ঢাকায় আসেন ২০১৮ সালে। ২০২০ সালে একটি তথ্যচিত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হো চি মিন প্রথমবারের মতো ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে নিজের পরিচয় দেন। এরপর পরিবার, সমাজে শুরু হয় তোলপাড়। হো চি মিনের সংগ্রামের মাত্রাও বাড়ে।
হো চি মিন জানান, অস্ত্রোপচারের আগে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। তাঁর সহকর্মী অন্য নার্সরা ভিন্ন হাসপাতালে কাজ শুরুর আগে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পোশাক পরতেন, আগের পোশাক বদলে নিতেন। কিন্তু তিনি তা করতেন না। আগের পোশাকের ওপরেই নতুন পোশাক পরতেন। তাঁর পুরুষাঙ্গ আছে, এটা যদি কেউ বুঝে ফেলে, এ নিয়ে একধরনের হীনম্মন্যতা কাজ করত। অস্ত্রোপচার করে দেশে ফেরার পর এখন আর তা করতে হয় না। এখন পোশাক পরিবর্তন করেন।
হো চি মিন জানান, বয়ঃসন্ধির সময় নিজের শারীরিক পরিবর্তন দেখে ভয় পেতেন। আয়নায় নিজেকে দেখে কান্নাকাটি করতেন। দাড়ি বা পুরুষালি শরীর কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতেন না। বোনের সঙ্গে পুতুল খেলতেন। বোনের কাপড়, মায়ের শাড়ি পরতেন। এসব নিয়ে নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছে। জানালেন, একটি কর্মক্ষেত্রের বস কাপড় খুলে দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁর শরীরটা কেমন।
গত ১০ আগস্ট গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একা সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন হো চি মিন ইসলাম। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর ফেসবুকে হো চি মিন পোস্টে জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ৩০ মিনিটের বেশি সময় দেন। ট্রান্সজেন্ডারদের নানা সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। প্রধানমন্ত্রী হো চি মিনকে বলেছেন, দেশের সংবিধানে সমানাধিকার দেওয়া আছে। সরকার ট্রান্সজেন্ডারদের পাশে আছে ও থাকবে।
এর আগে ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে তথ্য অধিকার আইনের (আরটিআই) ব্যবহার নিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন দিনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন। ওই প্রশিক্ষণের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদও সংবিধানে সবার সমানাধিকারের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, মানবাধিকার কমিশনে দলিত, ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়াসহ সংখ্যালঘুদের অধিকারসংক্রান্ত কমিটি আছে।
হো চি মিন জানান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে একটি আইনের খসড়া করেছে। এতে ট্রান্সজেন্ডারদের স্বাস্থ্যসহ অধিকার ও সুরক্ষার নানা বিষয়ের উল্লেখ আছে। হো চি মিন বলেন, তাঁর বিশ্বাস, আইনটি চূড়ান্ত হলে ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার আদায়ের পথ মসৃণ হবে।