আয়েশা তাবাসসুম তাকওয়া ছিল ঢাকার বি এ এফ শাহীন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। প্রায় ১০ বছর বয়সী মেয়েটির বাসায় আদরের নাম ছিল আরিষা। স্কুলের পরিচয়পত্রের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তারপর সে নতুন পরিচয়পত্র, বই–খাতা, ব্যাগ নিয়ে নতুন ক্লাসে ভর্তি হতো। তবে তা আর হলো না। আয়েশার বই, খাতা, পরিচয়পত্র যা ছিল সবই পড়ে আছে, মেয়েটি টেবিলে আর কখনোই নতুন বই সাজিয়ে রাখবে না। কেননা, ডেঙ্গুতে হারিয়ে গেছে আয়েশা।
আয়েশা ছিল প্লাটিনাম গ্রুপে কর্মরত মো. আকতার হোসেন ও অনলাইন উদ্যোক্তা রোখসানা ইসলামের একমাত্র মেয়ে। আয়েশা ২০ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। এই মা–বাবা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না তাঁদের মেয়ে নেই।
আকতার হোসেন গতকাল বুধবার বললেন, ‘মেয়েটা মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত কথা বলেছে। শুধু একবার বাবা বলে চিৎকার করে মেয়েটা লাইফ সাপোর্টে চলে গেল। মেয়ের মুখ থেকে শেষ যে শব্দটি বের হয়, তা ছিল বাবা। মেয়েটা চলে যাওয়ায় কাকে দোষ দেব? এ নিয়ে কথা বলেই–বা কী লাভ? এটা আমাদের ভাগ্যে ছিল।’
মেয়ে মারা যাওয়ার পর থেকেই রোখসানা ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ কথা বললেই তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তিনি ভুলে যাচ্ছেন মেয়ে আর ফিরবে না, শুধু ভাবেন মেয়ে কোথাও গেছে, এই তো ফিরল বলে। যখন বাস্তবতা বুঝতে পারেন, তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন না। প্রথম আলোকে এই মা বললেন, ‘মেয়েটা যখন আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিল না, তখন বলতে থাকে মা দম বন্ধ হয়ে আসছে। অক্সিজেন খুলে দাও। আম্মু এক সেকেন্ডের জন্যও আমার কাছ থেকে যাবে না, তুমি গেলেই আন্টিরা (নার্স, চিকিৎসক) কষ্ট দেয়। ইনজেকশন দেয়। তুমি পাশে থাকলে আমার কষ্ট কম হয়।’
একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশাহারা রোখসানা বলেন, ‘আমার একটাই মেয়ে ছিল। কীভাবে মানব এই মেয়ে নেই। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছা করছে। আর একটা বাচ্চা থাকলে তাকে জড়িয়ে ধরে হলেও মনটাকে একটু শান্ত করতে পারতাম।’
রাজধানীর নাখালপাড়ার বাসিন্দা আকতার হোসেন জানালেন, ১৫ আগস্ট মেয়ের জ্বর আসে। মেয়ের ডেঙ্গু পজিটিভ আসার পর রাতেই চিকিৎসককে দেখানো হয়। সে ভালো ছিল। সবার সঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করে। কিন্তু রাতে জ্বর বেড়ে যায়। বমি করতে থাকে। ১৮ আগস্ট রাত দুইটার সময় সরকারিভাবে ঘোষিত ডেঙ্গু চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। মেয়ের নার্ভ খুঁজে পেয়ে স্যালাইন দেওয়া সম্ভব হলেও রক্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। প্রতি ঘণ্টায় মেয়ের পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে।
তারপর সেই হাসপাতাল থেকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯ আগস্ট মেয়ের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষায় দেখা যায়, প্লাটিলেট কমে গেছে। রাতে প্লাটিলেট দেওয়া হয়। কিন্তু ২০ আগস্ট ভোরে মেয়ের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পেট ফুলে যায়। ফুসফুসে পানি ছড়িয়ে পড়ে। তারপর লাইফ সাপোর্টসহ যা যা করা সম্ভব সবই করা হলো, কিন্তু মেয়েটাকে ফেরানো গেল না। এই বাবা বললেন, ডেঙ্গুতে জ্বর কমে গেছে, ভালো আছে—এসব ভেবে নিশ্চিন্ত হলে চলবে না, মেয়েকে হারিয়ে এ শিক্ষাটাই পেয়েছেন তিনি।
আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাঝরাতে মেয়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয় জানিয়ে মা রোখসানা ইসলাম বলেন, ‘আইসিইউর এসিতেও মেয়েটা অস্থির হয়ে বলতে থাকে মা বাতাস দাও। ওর চিকিৎসার ফাইল দিয়েই বাতাস করছিলাম। কিন্তু মেয়েটা কোনোভাবেই আরাম পাচ্ছিল না। আমি কেন বাতাস দিতে পারছি না, তা নিয়ে রাগ করছিল। একসময় বলে বাবা কই? বাবাকে আসতে বলো। মেয়েটা বেশি অস্থির হয়ে পড়লে আমাকে আর মেয়ের কাছে থাকতে দেননি চিকিৎসকেরা। মেয়ের বাবা ভেতরে ঢুকলেন। তারপর শুনেছি, মেয়ে বাবা বলে চিৎকার দিয়েই এই পৃথিবী থেকে চলে গেল।’
মা ও মেয়ে বেশির ভাগ সময় এক রকমের জামা পরতেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। রোখসানা ইসলামের জন্মদিন ছিল ১৫ আগস্ট, মেয়ে মায়ের জন্মদিনে একটি বইও উপহার দেয়। মা ও মেয়ে সব সময় নিজেদের সুখ–দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতেন। মেয়ে ছোট হলেও মায়ের কোনো কষ্ট থাকলে তা বুঝতে পারত।
রোখসানা ইসলাম জানালেন, তাঁর বাবা দুই বছর আগে করোনায় মারা যান। একবার বাবার শ্বাসকষ্টের সাক্ষী হয়েছেন আর এবার মেয়ের কষ্ট দেখতে হলো।
আয়েশার মতো আরও অনেক শিশু এ বছর মায়ের কোল ছেড়ে গেছে ডেঙ্গুর কারণে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতেই এ সংখ্যা এক শর কাছাকাছি পৌঁছেছে। সন্তান হারানো বাবা–মায়েদের কাছে তাঁদের সন্তান শুধু একটি সংখ্যা নয়। আকতার হোসেন ও রোখসানা ইসলাম বলছেন, যাঁরা সন্তান হারাচ্ছেন, শুধু তাঁরাই এর কষ্টটা বুঝতে পারবেন। সরকার, সিটি করপোরেশনের মশা মারার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ কষ্টটা বুঝতে পারবেন না। বুঝতে পারলে হয়তো নগরবাসী মশার হাত থেকে রেহাই পেতেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ না কমার পেছনে মশা নিধনে ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছেন, চিকিৎসাসেবা দিলেও মশা না কমলে দেশে ডেঙ্গু রোগীও কমবে না।
তবে মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের বয়ানে আকতার হোসেন বা রোখসানা ইসলামের আর কিছুই এসে যায় না। রোখসানা ইসলাম বললেন, ‘মেয়েকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার পর আমরা দুজন মেয়ের নরম দুটি হাত ধরে চুমু দিলাম। মেয়েটার নিথর দেহ, দুই চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি ফেলে মেয়েটা। মেয়ের চোখের পানি মুছে দিলাম। অথচ এই মেয়েই সব সময় আমার চোখে কখনো পানি এলে তা মুছে দিয়ে চুমু দিত। আমরা কীভাবে মেনে নেব আমাদের মেয়েটা নেই।’