মা সানজিদা খানের সঙ্গে শাহারিয়ার খান আনাস। এ ছবি এখন স্মৃতি
মা সানজিদা খানের সঙ্গে শাহারিয়ার খান আনাস। এ ছবি এখন স্মৃতি

‘অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি’

‘অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি। যে দেশটাকে ছেলে ভালোবাসল, সেই দেশ তো নিরাপত্তা দিতে পারল না। আমার বুক তো খালি হয়ে গেল। আল্লাহ যেন এর বিচার করেন।’

কথাগুলো ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি চলাকালে গুলিতে নিহত শাহারিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খানের।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ৫ আগস্ট ওই কর্মসূচি চলাকালে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় নিহত হয় ১৬ বছর ৯ মাস বয়সী শাহারিয়ার।

সেদিন দুপুরের দিকে শাহারিয়ারের মা সানজিদা খান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড হাসপাতাল) থেকে ছেলের লাশ নিয়ে বাসায় ফেরেন। শাহারিয়ারের বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগেছিল।

সানজিদা খান বলেন, ছেলের লাশ হাসপাতাল থেকে বাইরে আনার পর বাসায় ফেরার জন্য কোনো যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্যাটারিচালিত এক অটোরিকশাচালক যেতে রাজি হন। অটোরিকশায় তিনি ও তাঁর স্বামী বসেন। কোলে নেন ছেলের লাশ। এভাবেই বাসায় ফেরেন তাঁরা।

পরিবারের সদস্যদের মাঝে শাহারিয়ার খান আনাস

৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শাহারিয়ার কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়েছিল। সে বাসায় মায়ের জন্য একটি চিঠি রেখে গিয়েছিল।

বেলা দেড়টার দিকে অপরিচিত একজন সানজিদা খানকে ফোন করে দ্রুত মিটফোর্ড হাসপাতালে যেতে বলেন। তখন এই মা ভেবেছিলেন, ছেলের শ্বাসকষ্ট আছে, সে হয়তো কাঁদানে গ্যাসের শেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর বড় কোনো অঘটন ঘটলে গায়ে রাবার বুলেট লাগতে পারে। তবে হাসপাতালে গিয়ে মা দেখেন, সিঁড়ির পাশে একটি স্ট্রেচারে পড়ে আছে ছেলের রক্তাক্ত নিথর দেহ।

সানজিদা খান বলেন, ‘এমন দৃশ্য যেন আর কোনো মাকে দেখতে না হয়।’

শাহারিয়ারের পকেটে একটি পুরোনো ছোট মুঠোফোন ছিল। এতে সবার মুঠোফোন নম্বর ছিল। সেখান থেকে নম্বর নিয়েই সানজিদা খানকে ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলেছিলেন আন্দোলনকারীদের একজন।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর গেন্ডারিয়ার সাধনা ঔষধালয়ের গলির দীননাথ সেন রোডে সানজিদা খানের বাবার ভাড়া বাসায় বসে কথা হয় পরিবারটির সদস্যদের সঙ্গে। এই বাসার কাছেই সানজিদা খানদের ভাড়া বাসা। সেখানে মা–বাবার সঙ্গে থাকত শাহারিয়ার। তার ছোট দুই ভাই আছে। পাঁচ বছর বয়সী সাফওয়ান ও দুই বছর বয়সী সুফিয়ান।

শাহারিয়ারের বাবা সাহরিয়া খান ছেলের বাসায় লেখার খাতা দেখাচ্ছেন

শাহারিয়ার নানার বাসাতেই বেশির ভাগ সময় থাকত। নানা সাইদুর রহমান খানের পকেটে থাকা টাকায় নাতির রক্তের দাগ লেগে ছিল। সেই টাকা তিনি খরচ না করে যত্ন করে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন। নানি শাহানা খানকে শাহারিয়ার ‘নানি’ না ডেকে ‘আম্মু’ ডাকত। তার সব আবদার ছিল নানির কাছেই।

শাহারিয়ারকে জুরাইন কবরস্থানে দাদির কবরে দাফন করা হয়েছে। শাহারিয়ার মারা যাওয়ার পর এলাকাবাসী দীননাথ সেন রোডের নাম পাল্টে ‘শহীদ আনাস সড়ক’ করেছেন। সাধনা ঔষধালয়ের দেয়ালে শাহারিয়ারের রেখে যাওয়া চিঠিটি বড় করে লেখা হয়েছে।

শাহারিয়ার প্রতিদিন বাইরে থেকে সকালের নাশতা কিনে আনত। ৫ আগস্ট মা সানজিদা খান ছেলেকে মুখ ধুতে দেখেছিলেন। তারপর আর ছেলেকে দেখেননি।

মা ভেবেছিলেন, ছেলে হয়তো নাশতা আনতে গেছে। তবে ছেলের ঘরে ঢুকে তার হাতে লেখা চিঠি পেয়ে মা অস্থির হয়ে যান।

মা যাতে চিন্তা না করেন, সে জন্য ছেলে আগেও ঘর থেকে বের হলে চিরকুটে ‘নানুর বাসায় যাচ্ছি’, ‘নাশতা আনতে যাচ্ছি’—এমন কথা লিখে যেত। মায়ের ধারণা, সেদিনও তিনি যাতে চিন্তা না করেন, তাই ছেলে চিঠিটি লিখে গিয়েছিল।

ছেলে শাহারিয়ারের চিঠি হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা

শাহারিয়ারের বাবা সাহরিয়া খান ছেলের বাসায় লেখার একটি রাফ খাতা বের করে দেখালেন। তিনি জানালেন, ছেলে আগেও দেশ, আন্দোলন নিয়ে নানান কিছু লিখেছিল, যা ছেলে মারা যাওয়ার আগে তিনি দেখেননি। সেই খাতায় সমন্বয়-সমন্বয়ক কাকে বলে, তাও লিখেছিল ছেলে।

মা সানজিদা খান জানালেন, ছেলে মারা যাওয়ার এক দিন আগে থেকে তাঁর মনটা অস্থির ছিল। পরিবার ও আত্মীয়দের মধ্যে যাঁরা বাইরে বের হচ্ছিলেন, তাঁদের তিনি ফোন করে সতর্ক করছিলেন।

শাহারিয়ার মা–বাবার কথার অবাধ্য হতো না। ঘর থেকেও তেমন একটা বের হতো না। তাই ছেলেকে সতর্ক করার কথা মাথায় আসেনি মা–বাবার। কিন্তু এই ছেলেই যে কিছু না বলে এমন করে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে, তা তাঁরা কল্পনাও করেননি।

শাহারিয়ারের জন্মদিন ১৪ অক্টোবর। জন্মদিন উপলক্ষে মা–বাবা ছেলেকে একটি মুঠোফোন কিনে দিয়ে চমক দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উল্টো ছেলেই তাঁদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।

শাহারিয়ারের রেখে যাওয়া চিঠি বড় করে লেখা হয়েছে দেয়ালে

জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় শাহারিয়ারের বাবার নামের বানান ভুল হয়। ‘শাহারিয়ার’-এর স্থলে লেখা হয়েছিল ‘সাহরিয়া’। তখন বাবা ঠিক করেছিলেন, নিজের আসল নামে ছেলের নাম রাখবেন। তাই বাবা ও ছেলের নামের এমন মিল।

আন্দোলনে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব ছিল ছেলে। বাবার নিষেধ থাকায় সে যেতে পারছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত ছেলেকে আর আটকে রাখা যায়নি।

ছেলে আন্দোলনে যেতে পারছিল না বলে মন খারাপ করত। তাই মা ছেলের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন। মায়ের এখন আক্ষেপ, ৫ আগস্ট ছেলের সঙ্গে গেলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটত না।

৪ আগস্ট দিবাগত রাত তিনটা পর্যন্ত শাহারিয়ার মা–বাবার সঙ্গে টেলিভিশনে আন্দোলনের খবর দেখেছিল। সে ঘুমাতে যাওয়ার পর টেলিভিশনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা থেকে লাইভ দেখানো হচ্ছিল। তা দেখে বাবা ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিলেন। তখন ছেলে বলেছিল, ‘মাত্র ঘুমিয়েছি।’ এটাই ছিল বাবার সঙ্গে ছেলের শেষ কথা।

শাহারিয়ারকে স্মরণ

১৮ বছর বয়সে সানজিদা খানের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরপরই ছেলে শাহারিয়ারের জন্ম। বলতে গেলে মা-ছেলে একই সঙ্গে বড় হয়েছে। তাই দুজনের সম্পর্কও ছিল বন্ধুর মতো।

দুপুরে স্কুল থেকে ছেলে ফিরলে সবাই মিলে খাবার খেতেন। সানজিদা খানের কোনো মেয়ে না থাকায় শাহারিয়ারই তাঁকে তাঁর দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করত। মায়ের কাছে ছেলের তেমন কোনো বায়না ছিল না। করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকে বাবার ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। বিষয়টি বুঝত শাহারিয়ার।

সানজিদা খান বলেন, ‘সেদিন (৫ আগস্ট) সকালে একবার শুধু ছেলের মুখটা দেখেছিলাম। আর যা বলার, তা তো সে চিঠিতেই লিখে গেছে। তবে যে চিঠি লিখে গেছে, তা পড়ে তো আর...।’

বাসার একটি চাবি শাহারিয়ারের কাছে থাকত। চাবি যাতে না হারায়, সে কথা সানজিদা খান সব সময় ছেলেকে বলতেন। অন্যদিন চাবিটি সঙ্গে রাখলেও সেদিন ছেলে ঠিকই চাবিটি বাসায় রেখে গিয়েছিল বলে জানালেন সানজিদা খান।

শাহারিয়ার গেন্ডারিয়ার আদর্শ একাডেমিতে বিজ্ঞান বিভাগে দশম শ্রেণিতে পড়ত

শাহারিয়ার ছাত্র হিসেবে বেশ ভালো ছিল। গেন্ডারিয়ার আদর্শ একাডেমিতে বিজ্ঞান বিভাগে দশম শ্রেণিতে পড়ত সে। ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিল শাহারিয়ার।

বাবা সাহরিয়া খান জানালেন, ৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার পর ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। তখন জানতে পারেন, ছেলে চিঠি লিখে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে চলে গেছে। ছোট ছেলে, সে আন্দোলনে গেল, আর বাবা হয়ে তিনি ঘরে বসে আছেন, এ কথা চিন্তা করে সাহরিয়াও বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। তারপর স্ত্রীর ফোন পেয়ে জানতে পারেন, দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। শাহারিয়ারের মরদেহ নিয়ে ফেরার পর এলাকাবাসী লাশ নিয়ে মিছিল করেছিলেন।

সাহরিয়া খান বলেন, ছেলেকে ভালোবেসে এলাকাবাসী একটি সড়কের নামকরণ করেছেন। তিনি চান, সরকারি প্রক্রিয়ায় সড়কটি তাঁর ছেলের নামে নামকরণ করা হোক। ছেলে যেহেতু দেশের জন্য আন্দোলনে মারা গেছে, তাই সরকার স্বীকৃতি দিক, তাকে সম্মান দিক।

ছেলের লাশ দুপুরের দিকে বাসায় আনা হয় জানিয়ে সানজিদা খান বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর সবাই আনন্দ-উল্লাস করছিল। মিছিল করছিল। কিন্তু তাঁদের তো আর সে অবস্থা ছিল না। ছেলে যে দেশের স্বপ্ন দেখে জীবন দিল, সেই গণতান্ত্রিক দেশ চান তাঁরা।

শাহারিয়ারের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ব্যানার টানানো হয়েছে

শাহারিয়ারের লাশ এলাকাবাসী একটি বড় পতাকা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন বলে জানান সানজিদা খান। কোলে করে ছেলের লাশ আনার সময় সানজিদা খান ও সাহরিয়া খানের জামা-কাপড়ে রক্ত লেগেছিল। এগুলো সবই স্মৃতি হিসেবে তাঁরা রেখে দিয়েছেন।

শাহারিয়ার তার মাকে চিঠিতে লিখেছিল, ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য কোরে বের হোলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না...।’

চিঠির শেষে শাহারিয়ার লিখেছে, ‘একদিন তো মরতেই হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় কোরে স্বার্থপরের মতো ঘরে বোসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যুও অধিক শ্রেয়। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়, সেই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেচে না ফিরি তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।-আনাস।’

সানজিদা খান বললেন, ‘কোনো মা চায় না, এভাবে গর্বিত হতে। আমার সন্তান আমার কাছে সর্বোচ্চ দামি ছিল।’

সানজিদা খান স্মৃতিচারণা করে বললেন, কোনো এক পবিত্র রমজানের ঈদের দিন শাহারিয়ারের জন্ম হয়েছিল। আর সে মারা গেল সরকার পতনের দিনে বা বিজয়ের দিনে।