কালিতে কালান্তর

১০৮ ফুট ক্যানভাসে জয়নুলকে স্মরণ

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিনে আয়োজিত ‘কালিতে কালান্তর’ শিরোনামে যৌথ আয়োজনে ছবি আঁকছেন শিল্পীরা। গতকাল দুপুর ১২টায় নগরের সিআরবির শীরিষতলায়
ছবি: সৌরভ দাশ

মোটা তুলি আর কালিতে মার্জানা আকতার ফুটিয়ে তুলছিলেন টিসিবির খোলা ট্রাক থেকে চাল নেওয়ার দৃশ্য। তাঁর পাশেই কেউ একজন এঁকেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সাঁওতাল যুগলের ছবির অনুকৃতি। সিআরবির শিরীষতলার বাঁধানো চত্বরে বিশাল ক্যানভাসের এক প্রান্তে এক মনে ছবি আঁকছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মার্জানা। কেন চাল নেওয়ার দৃশ্য আঁকার কথা মাথায় এল, জানতে চাইলে মার্জানা বলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল তাঁর সময়ের মানুষের দুর্দশা তুলে ধরেছেন ‘দুর্ভিক্ষ’, ‘সংগ্রাম’ কিংবা ‘মনপুরা-৭০’ ছবিতে। তাই জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এমন বিষয় নির্বাচন।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল নয়টায় শুরু হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সিআরবির শিরীষতলায় যৌথ ছবি আঁকার আয়োজন। ‘কালিতে কালান্তর’ শিরোনামে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের এই আয়োজনে অংশ নেন ৩৭ জনের মতো শিল্পী। শিল্পাচার্যের ১০৮তম জয়ন্তীতে ১০৮ ফুট দৈর্ঘ্যর ক্যানভাসে কালি ও তুলিতে ছবি আঁকেন শিল্পীরা। সকাল নয়টায় ক্যানভাসে ছবি এঁকে যৌথ শিল্প আয়োজনের উদ্বোধন করেন প্রবীণ চিত্রশিল্পী কে এম এ কাইয়ুম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শিল্পী সুব্রত দাশ।

শতবর্ষ পরেও জয়নুল তাঁর শিল্প ও সমাজভাবনা নিয়ে তরুণদের যে সমানভাবে উদ্দীপ্ত করতে পেরেছেন, মার্জানার মতো শিল্পীদের কাজ তারই সাক্ষ্য দিচ্ছিল। মার্জানা বলেন, জয়নুল এখন বেঁচে থাকলে হয়তো টিসিবির ট্রাকের সামনে অসহায় মানুষের দীর্ঘ সারির ছবি আঁকতেন।

ক্যানভাসে কালিতেই কেন ছবি এঁকেছেন শিল্পীরা, তা আর নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। জয়নুলের প্রিয় মাধ্যম সস্তার উপকরণ কালি, টুকরা কাগজ কিংবা মার্কিন কাপড়। তাঁর জন্মতিথিতেও সেই সহজ সাধারণ উপকরণ ক্যানভাসকে জীবন্ত করে তুলল।

বেসরকারি ইউডা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার প্রথম বর্ষের ছাত্র নাবিন আবতাহিও সেই প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। শিরীষতলার পাশেই রিকশা নিয়ে দাঁড়ানো রিকশাচালকের প্রতিকৃতি আঁকছিলেন তিনি।

যৌথ এই অঙ্কন প্রয়াস দেখতে এসেছিলেন লালখান বাজার এলাকার বাসিন্দা আরিফ আহমেদ। বললেন, এখানকার বিশাল ক্যানভাস দেখে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে ১৯৭৪ সালে জয়নুলের আঁকা ‘মনপুরা-৭০’ স্ক্রল চিত্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। শিল্পাচার্য তাঁর সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতিকে কখনো এড়িয়ে যাননি।

চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় সংঘটক ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্যের মুখে আরিফের কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল। তিনি বললেন, শিল্পাচার্যের প্রতি এখনকার তরুণ প্রজন্ম কী ভাবছে, তা জানার উপায় ছিল না। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে কিছুটা জানা গেল। তরুণদের মধ্যে শিল্পের স্পৃহা, জীবনবোধ, জনসম্পৃক্ততা দেখে তিনি আপ্লুত।

সিআরবি চত্বরে সকালের মিঠে-কড়া রোদ ফালা ফালা করে দিচ্ছিল সুবিশাল গাছগুলো। পাতার নকশাকাটা আলোছায়ার খেলা চারপাশে। মাত্র এসএসসির চৌকাঠ ডিঙানো শুভ দে সেই ছবি আঁকছিল ক্যানভাসের মাঝের একটা অংশে। ডালে বসা পাখি, বিচিত্র পাতা আর মানুষের অবয়ব। শুভ বলে, জয়নুলের রেখার সৌন্দর্য তাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। সবকিছুর মধ্যেই সে এই রেখা খুঁজে পায়। গাছ-পাতা, মানুষের সংগ্রাম—সব মিলিয়ে জয়নুলের জগৎকে তার স্বপ্ন বলেই মনে হয়।