‘এ–বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,/ নারী দিল তাহে রূপ-রস–মধু-গন্ধ সুনির্মল।’ কৃষিতে নারীর অবদান তুলে ধরে এভাবেই লিখেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সভ্যতার শুরুর দিকে কৃষির উন্মেষ ঘটে নারীর হাত ধরেই। তখন প্রয়োজনীয় বীজ তাঁরা সংরক্ষণ করে পরে তা রোপণ করতেন। যুগ যুগ ধরে নারীরাই হয়েছেন কৃষির ধারক।
নানা উদ্ভিদের বীজ সংরক্ষণের প্রাচীন সেই প্রথা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার নারীরা। নানা পদের বীজ সংরক্ষণ করছে ওই উপজেলার চার ইউনিয়নের ১৭টি গ্রামের অন্তত ২০০টি পরিবার। এসব পরিবারের নারীদের কাছে ৮০ থেকে ২৫০ প্রজাতির দেশি জাতের বীজ সংরক্ষিত আছে।
কৃষিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই নারীরা নিজেদের অজান্তেই বড় একটি কাজ করে চলেছেন। এক দিকে দেশীয় জাতকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করছেন। অন্য দিকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করছেন। দেশীয় জাতের বীজ থেকে হওয়া গাছে পোকা কম হয়। এ কারণে তাতে সার ও কীটনাশক দেওয়ার প্রয়োজন হয় না তেমন। ফলে ওই পরিবারগুলোর নিরাপদ সবজির চাহিদা মিটছে।
দেশি জাতের শস্য ও সবজির বীজ সংরক্ষণ করেন ওই নারীরা। এমনকি বিপন্ন উদ্ভিদের বীজও সংরক্ষণে আছে অনেকের কাছে। প্রয়োজনে এসব বীজ নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদানও করেন নারীরা। এসব বীজ নিয়ে বছরে একবার মেলার আয়োজন করে কৃষক ও কৃষি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি একটি সংস্থা।
খুলনা কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ এস এম ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে আমাদের মা-চাচিরা এভাবে বীজ সংরক্ষণ করতেন। কিন্তু কালের আবর্তে তা হারিয়ে যেতে বসেছিল। এখন কৃষকদের নিজেদের ফসলের বীজ নিজেদের মতো করে সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এতে দেশীয় জাতগুলো টিকে থাকবে।’
ছোট ছোট প্লাস্টিকের কৌটা, কোমল পানীয়ের বোতল ও কাচের বোতলে বীজ সংরক্ষণ করেন নারীরা। বীজের ধরন অনুযায়ী পাত্র হয়। ছোট বীজের জন্য ছোট পাত্র, বড় বীজের জন্য বড় পাত্র। ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে স্বল্প পরিসরে প্রয়োজনীয় বীজ সংরক্ষণ করলেও আট বছর ধরে সব ধরনের বীজই সংরক্ষণ করছেন তাঁরা। বেসরকারি সংস্থা ‘লোকজ’ তাঁদের বীজ সংরক্ষণের পদ্ধতি ও সুফল সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। বীজ সংরক্ষণের ফলে পরিবারগুলোয় যেমন শাকসবজির চাহিদা মিটছে, অন্য দিকে সেসব সবজি বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন তাঁরা।
দীর্ঘদিন ধরে বীজ সংরক্ষণ করছেন উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের শুকদাড়া গ্রামের গৃহিণী শ্যামলী সরকার। প্রায় ৮০ জাতের বীজ তাঁর কাছে সংরক্ষিত। শস্য, সবজি থেকে শুরু করে আমলকী, বহেরা, হরীতকী, সফেদা, আতা, ডেউয়াসহ বিভিন্ন ফলের বীজও আছে তাঁর কাছে। যখন প্রয়োজন হয় তখন বীজ নিয়ে বপন করেন বাড়ির আঙিনা ও পড়ে থাকা জমিতে। এতে সারা বছরই নিজের বাড়িতেই শাকসবজি পান তিনি।
২২ সেপ্টেম্বর বিকেলে শ্যামলী সরকারের বাড়িতে দেখা যায়, ঘরের সামনের উঠানের একচিলতে জমিতে লাগানো হয়েছে ওল। পাশেই লালশাক, ডাঁটাশাক ও ঢ্যাঁড়সগাছ। ঘরের চালে ঝুলছে লাউ, চালকুমড়া ও চিচিঙ্গা। আরও বিভিন্ন জায়গায় এমন সবজির চাষ করেছেন তিনি। কোনো ফাঁকা জায়গা নেই।
শ্যামলী সরকার বলেন, ‘নিজের সংরক্ষণ করা বীজ থেকেই শাক, সবজি লাগাই। পাড়ার যাঁদের যে বীজ প্রয়োজন, তা আমার কাছ থেকে নিয়ে যান।’
বীজ সংরক্ষণের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বটিয়াঘাটা সদর ইউনিয়নের বলাবুনিয়া গ্রামের অনিন্দিতা রায় প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় জাতের ফল, সবজি ও শস্যের পুষ্ট বা সবল দানা থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেটি ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। বীজ যখন মোটামুটি শুকনো হয়ে যায়, তখন সেটি কাচের বা প্লাস্টিকের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। কাচের পাত্রে বীজ সংরক্ষণ সবচেয়ে ভালো। বীজ সংরক্ষণে যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়, তা হলো, ভিজে ভাব না থাকা ও বর্ষা বা ঠান্ডায় আর্দ্রতা নষ্ট না হওয়া। প্রতি এক মাস পরপর বীজগুলো রোদে দিয়ে শুকিয়ে আবার বোতলজাত করে রাখতে হয়। এতে বীজের আর্দ্রতা ভালো থাকে।
বীজ না থাকলে কৃষক হয় না—আগে গ্রামে এমন ধারণা প্রচলিত ছিল। হাইব্রিডের (উচ্চফলনশীল জাত) এই জামানায় সে ধারণা এখন বদলে গেছে। কৃষকেরা বীজের জন্য এখন বিভিন্ন কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। প্রতিবছরই তাঁদের বীজ কিনতে হয়। তবে হাইব্রিড ফসলের বীজ থেকে পরে আর ভালো ফলন হয় না। সে জন্য ঘরেই অনেকে বীজ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন।
শুকদাড়া গ্রামের চন্দনা সরকার বলেন, ‘হাইব্রিড শাকসবজির বীজ থেকে পরে ভালো ফলন হয় না। এতে বীজের প্রয়োজন হলেই ছুটতে হয় দোকানে। কেনা বীজ থেকে কোনো কারণে চারা না হলে বা নষ্ট হয়ে গেলে আবারও কিনতে হবে। পাশাপাশি দিতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী সার ও কীটনাশক। কিন্তু দেশীয় জাতের বীজে ওই সমস্যা নেই। হাইব্রিড বীজের কারণে আমরা কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছি।’ তিনি আরও বলেন, দেশীয় জাতের বীজ থেকে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে চারা হতে পারে। থাকেও অনেক দিন, সহজে নষ্ট হয় না। হাতের কাছে বীজ থাকে বলেই যেকোনো সময় বীজ বপন করা যায়। এতে বাড়িতে বারো মাসই সবজি থাকে। বাজার থেকে সবজি কিনতে হয় না। আর বাড়ির এসব শাকসবজি রাসায়নিক ও কীটনাশকমুক্ত।
হাইব্রিডের ভিড়ে এভাবে দেশীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ ওই এলাকায় বেশ সাড়া ফেলেছে। অনেকেই এখন নিজেদের মতো করে বীজ সংরক্ষণ করছেন। অন্যদের যখন বীজের প্রয়োজন হয় তখন তাঁরা হাত পাতেন বীজ সংরক্ষণকারীদের কাছে। অনায়াসে বিনা মূল্যে দিয়েও দেন তাঁরা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) অধ্যাপক মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাইব্রিডের কারণে দেশীয় শাকসবজি, ফলমূল, শস্য হারিয়ে যেতে বসেছে। সে ক্ষেত্রে ওই নারীদের এমন উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এতে দেশি জাতটি টিকে থাকবে। অন্যদিকে কৃষকদের ওপর বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির দৌরাত্ম্য কমবে।
নারীদের সংরক্ষণে থাকা বীজের প্রদর্শনী ও আদান-প্রদানের জন্য প্রতিবছর বীজমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। বীজ সংরক্ষণে উৎসাহিত করতে ৯ বছর ধরে ওই মেলার আয়োজন করছে প্রতিষ্ঠানটি। মেলার উদ্দেশ্য হলো, হারিয়ে যাওয়া দেশি জাতের বীজ বিনিময় ও প্রদর্শন করা। ওই মেলায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে বীজ নিয়ে হাজির হন নারীরা। সবচেয়ে বেশি বীজ থাকা তিন নারীকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়।
সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ উপজেলার গঙ্গারামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে বসেছিল ওই মেলা। মেলায় প্রায় ১০০ নারী পসরা সাজিয়েছিলেন বীজের। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে মেলা। বীজ সংরক্ষণকারীদের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে মেলাটি।
মেলায় লক্ষ্মী রানী মণ্ডল নিয়ে এসেছিলেন ২৪৮ জাতের বীজ। সামনে সাজানো ছিল বিভিন্ন জাতের বীজ আর মাথার ওপর দেয়ালে সাঁটানো কর্কশিটে লেখা ছিল ‘লক্ষ্মী বীজ ভান্ডার’। লক্ষ্মী রানী মণ্ডল বলেন, কয়েক বছর ধরে এ ধরনের বীজমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এতে বাড়ির গৃহিণীরা আরও বেশি বীজ নিজেদের সংগ্রহে রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন।
বেসরকারি সংস্থা লোকজর নির্বাহী পরিচালক দেবপ্রসাদ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, কৃষির ইতিহাস নারীদের হাত ধরেই। আগে গ্রামের এসব নারী নিজেদের মতো করে বীজ সংরক্ষণে রাখতেন। অনেক সময় তা নষ্ট হয়ে যেত। তাঁদের বীজ সংরক্ষণের পদ্ধতি শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আর নষ্ট হয় না। যাঁরা বীজ সংরক্ষণ করেন, সেসব বাড়িতে কখনো শাকসবজির ঘাটতি হয় না। তাঁরা বিষমুক্ত সবজি চাষ করতে পারেন।