ডিজিটাল মিটার বসানোর খরচ গ্রাহককেই মেটাতে হবে।
৮৬ হাজার ৩০৯ জন গ্রাহকের ঘাড়ে বাড়তি খরচের চাপ।
ওয়াসার এমডির দাবি, গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে।
পাঁচ বছরে তিন দফায় ৯০ হাজার পানির মিটার কিনেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ২৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ চালানটি কেনা হয় দুই বছর আগে। গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণের পর এসব মিটার বসানোও হয়েছে। সবকিছুই ঠিকঠাক। কিন্তু এখন ওয়াসা বলছে, এসব মিটারে কারসাজির সুযোগ আছে, ভুল বিল হয়। তাই বাদ দিতে হবে। এ জন্য নতুন ৯০ হাজার মিটার কিনতে ২০০ কোটি টাকায় আবার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
ওয়াসার প্রকৌশলীরা বলছেন, আগে কেনা মিটারগুলো মেকানিক্যাল (ওয়াসার কর্মীদের সশরীর গিয়ে বিল রিডিং করতে হয়)। নতুন করে কেনা হবে ডিজিটাল মিটার। ২৭ কোটি টাকার খরচের পর পাঁচ বছর না যেতেই মিটার বদলানোকে অপচয় হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ওয়াসার ভুল পরিকল্পনার গচ্চা এই ২৭ কোটি টাকা।
ডিজিটাল মিটার বসানোর জন্য ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল মিটার বসানোর যুক্তি হিসেবে ওয়াসার দাবি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিলের রিডিং নিতে হবে না। সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় বিল হবে। অথচ মেকানিক্যাল মিটার কেনার সময়ও বলা হয়েছে, ‘ভালো’ মানের মিটার কেনা হচ্ছে। সঠিক বিল পাওয়া যাবে।
বর্তমানে ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। আগের মিটার পরিবর্তনের জন্য প্রতিজন গ্রাহককে প্রায় চার হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এখন ডিজিটাল মিটার বসালে খরচ গ্রাহককেই মেটাতে হবে।
ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকের ঘাড়ে দ্বিতীয় দফায় বাড়তি টাকার চাপ তুলে দেবে ওয়াসা। সবচেয়ে বড় কথা, গ্রাহকের কথা ভেবে নয়, মূলত নতুন প্রকল্প নিলেই কর্মকর্তারা লাভবান হন।
ওয়াসা সূত্র জানায়, মেকানিক্যাল মিটারের প্রথম চালানটি কেনা হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। এরপর ২০১৯ সালের জুন মাসে আরেক দফা মিটার কেনা হয়।
ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। আগের মিটার পরিবর্তনের জন্য প্রতিজন গ্রাহককে প্রায় চার হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এখন ডিজিটাল মিটার বসালে খরচ গ্রাহককেই মেটাতে হবে।
কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের (ফেজ-২) আওতায় দুই দফা ৫০ হাজার মিটার কিনেছে সংস্থাটি। ইতালির একটি কোম্পানি থেকে এসব মিটার কেনা হয়। প্রতিটি মিটারের দাম পড়ে ২ হাজার ৭৯ টাকা। ফলে ৫০ হাজার মিটারের জন্য খরচ হয় ১০ কোটি ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
অন্যদিকে সংস্থার ক্রয় শাখার মাধ্যমে ২০২০ সালের মাঝামাঝি তুরস্ক থেকে ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা খরচ করে ১৫ হাজার মিটার কেনা হয়। ২০২২ সালে একই দেশ থেকে কেনা হয় ২৫ হাজার মিটার। খরচ হয় ১০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মিটার কেনা বাবদ সব মিলিয়ে খরচ হয় ২৬ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
গ্রাহকের ঘাড়ে দ্বিতীয় দফায় বাড়তি টাকার চাপ তুলে দেবে ওয়াসা। সবচেয়ে বড় কথা, গ্রাহকের কথা ভেবে নয়, মূলত নতুন প্রকল্প নিলেই কর্মকর্তারা লাভবান হন।ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলমের দাবি, মেকানিক্যাল মিটার সাধারণত চার-পাঁচ বছরের বেশি চালানো যায় না। কিন্তু চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইতালি কিংবা তুরস্ক থেকে কেনা মিটারগুলো সাধারণত সাত-আট বছর ব্যবহার করা যায়। তবে কোন মানের মিটার কেনা হয়েছে, সেটি বড় বিষয়।
এখন ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প’ নামের আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পে ৩০০ কিলোমিটার নতুন পাইপলাইন তৈরি হবে। ৫০ হাজার গ্রাহককে পানির ব্যবস্থা করা হবে। যার মধ্যে ১০ হাজার নতুন গ্রাহক থাকবে। পাশাপাশি ৯০ হাজার ডিজিটাল মিটার কেনা হবে। প্রতিটি মিটারের দাম পড়বে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। প্রকল্পে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। মিটার কেনা, বসানো ও পরিচালনায় খরচ হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
আগের মিটারগুলো মেকানিক্যাল। এসব মিটারে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই ডিজিটাল মিটার কেনা হচ্ছে।ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ
মিটার কেনা নিয়ে ‘বিতর্ক’
ইতালি ও তুরস্ক থেকে মিটার কেনার আগে সেসব দেশে গিয়ে কারখানায় মান যাচাই করে এসেছিলেন ওয়াসার কর্তাব্যক্তিরা। কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, আগের কেনা মিটারের মান খুবই ভালো। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে এসব মিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন এত ভালো মানের মিটার পরিবর্তন করা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কারণ, ২০২২ সালেও ৩ হাজার ডিজিটাল মিটার কেনার প্রকল্প নিয়েছিল সংস্থাটি। সেসব মিটার বসানোর কাজ এখনো শেষ হয়নি। ছয় মাসের মধ্যে মিটার বসানোর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি।
ওয়াসার পাঁচজন গ্রাহক ও বোর্ডের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পনা না করেই কখনো মেকানিক্যাল মিটার, কখনো ডিজিটাল মিটার কেনা হচ্ছে। এখন আবার নতুন করে আরও ৯০ হাজার মিটার কেনার পরিকল্পনা চলছে। অথচ আগের ৩ হাজার ডিজিটাল মিটারও এখনো বসানো হয়নি।
মিটার কেনার বিষয়ে সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আগের মিটারগুলো মেকানিক্যাল। এসব মিটারে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই ডিজিটাল মিটার কেনা হচ্ছে।
আগে কেন ডিজিটাল মিটার কেনা হয়নি—এ প্রশ্নে এমডি দাবি করেন, ‘প্রতিবছর সারা বিশ্বে মিটার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসছে। আর ডিজিটাল মিটারগুলো দামি। গ্রাহকের এত দামি মিটার কেনার সামর্থ্যও ছিল না। এখন আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে।’
মিটার কেনা নিয়ে ওয়াসার পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগেই ডিজিটাল মিটার কেনা হলে এত অর্থের অপচয় হতো না। সঠিকভাবে বিলও পাওয়া যেত; কিন্তু সেটি হয়নি। ফলে ডিজিটাল মিটার কেনা হলে সেটি কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় বসানো হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট পরিকল্পনা করা উচিত। এ ছাড়া যেসব মেকানিক্যাল মিটার সচল থাকবে, সেসব পরিবর্তন করা উচিত হবে না।