দগ্ধ স্বামী সংকটাপন্ন, অনাগত সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় জান্নাতুল

ট্রলারে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ ওসমান গনির শয্যাপাশে তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল।  চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ছবি: প্রণব বল

আনন্দেই দিন কাটছিল জান্নাতুল ওয়াকিয়ার (১৮)। স্বামী ওসমান গনি (২১) সাগর থেকে সবে ফিরেছিলেন। এদিকে কদিন পরই তাঁর কোলজুড়ে আসবে সন্তান। কিন্তু আকস্মিক এক বিস্ফোরণ জান্নাতুলের সবই বদলে দিল। আনন্দ রূপ নিল বিষাদে। তাঁর চোখেমুখে এখন রাজ্যের অন্ধকার।

আজ শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটার ৬ নম্বর ঘাট এলাকায় মাছ ধরার একটি ট্রলারে বিস্ফোরণ হয়। এতে ট্রলারে থাকা ১২ জেলে দগ্ধ হন।

ওসমান গনিসহ দগ্ধ জেলেদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।সেখানে চিকিৎসাধীন ১০ জেলের অবস্থাই সংকটাপন্ন।

হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসা দিচ্ছেন মো. রাশেদ উল করিম। এই চিকিৎসক জানালেন, ওসমান গনিসহ সবার শ্বাসনালি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।তাদের শরীরের ৩০ থেকে ৯০ ভাগ পুড়ে গেছে।

চমেকের বার্ন ইউনিটে স্বামীর মাথার পাশে বসে ছিলেন জান্নাতুল। স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁর যন্ত্রণা লাঘবেরর চেষ্টা করছিলেন তিনি। মাঝেমধ্যে জানালার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছেন। বললেন, ‘আমার দুই বাচ্চা। ছয় মাসের এক ছেলে মারা গেছে আট মাস আগে। আরেকটা পেটে।’

স্বামী ওসমান গনির কিছু হলে তাঁর ও অনাগত শিশুর কী হবে তা ভাবতেই পারছেন না জান্নাতুল। বললেন, ‘১২ দিন পর গতকাল সাগর থেকে ফিরেছে সে (ওসমান গনি)। আমার শরীরের খোঁজ খবর নিল। আগামী মাসে সন্তান প্রসবের সময়। এর মধ্যে এমন ঘটনা। আমি কী করব জানি না।’

ওসমানে গনিরা দুই ভাই ও এক বোন। ভাই–বোনদের মধে৵ তিনি ছোট। স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন কক্সবাজার সদরে। মাছ ধরে সংসার চলে।স্ত্রী ছাড়া হাসপাতালে দেখা গেল তাঁর বড় বোন কোহিনুর বেগমকে।

কোহিনুর বললেন, ‘সকাল সাতটার দিকে ট্রলারে যায় ওসমান। এক ঘণ্টা পর খবর আসে ট্রলারে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ওসমানসহ ১০–১৫ জন দগ্ধ। এরপরে তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। আমার ভাইটা খুব দুঃখী। তাঁর ছেলেটা মারা গেছে। এখন তাঁকেও মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে।’  

দগ্ধ ১০ জেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১০ জেলের কারও কথা বলার অবস্থায় নেই। সবাই কাতরাচ্ছেন। বার্ন ইউনিটের করিডরে একটা ট্রলিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওসমানের আরেক সঙ্গী জেলে মো. আরমানকে (২০)। ট্রলি ধরে মেঝেতে বসে আছেন তাঁর স্ত্রী সুখী আকতার। পাশে একমাত্র সন্তান আড়াই বছরের মেয়ে মরিয়ম আকতার। বাবার কী হয়েছে এখনো বোঝার বয়স হয়নি মরিয়মের।

সুখী আকতারের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বললেন, ‘এত দিন পর বাবা বাড়ি ফেরায় খুব খুশি ছিল মেয়েটা। লোকটা সকালেই চা খেয়ে ট্রলারে গেল। মাছ বিক্রির কথা ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর খবর এল তাদের এ অবস্থা। মেয়েকে দেখার কেউ নেই। তাই তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসি।’

বিস্ফোরণে শরীরের ৯০ ভাগই পুড়ে গেছে জেলে দিল মোহাম্মদের। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। বারবার শয্যা থেকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। চিৎকার করে তিনি বলছিলেন, ‘বাতাস করো বাতাস করো।’ পাশে থাকা স্ত্রীকে গালাগাল দিয়ে বলছিলেন, ‘এখানে কোথায় এনেছ আমাকে!’

মো. রফিকের এক মেয়ে এক ছেলে। থাকেন কক্সবাজার সদরে। দিল মোহাম্মদের উল্টো দিকের শয্যায় রাখা হয়েছে তাঁকে। তিনিও কাতরাচ্ছিলেন। তাঁর শয্যার পাশে বসে ছিলেন স্ত্রী জোবাইদা। ছেলেমেয়েদের বাসায় রেখে স্বামীর সঙ্গে হাসপাতালে এসেছেন। জোবাইদার চোখেমুখে বিষাদ।

দগ্ধ স্বামী আরমানকে ট্রলিতে রাখা হয়েছে। তার পাশে শিশুসন্তানসহ বসে আছেন তাঁর স্ত্রী সুখী আকতার

শয্যা ফাঁকা না থাকায় শফিকুল ইসলামকে রাখা হয়েছে হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে। তাঁর স্ত্রী তসলিমা আছেন কক্সবাজারে বাসায়। শফিকুলের সঙ্গে হাসপাতালে এসেছেন তাঁর বোন রশিদা বেগম। ভাইয়ের আহাজারি দেখে তিনি বলেন, ‘কী কষ্ট পাচ্ছে আমার ভাইটা। জানি না কী হবে।’

সবার পাশে আত্মীয়স্বজন কেউ না কেউ থাকলেও ভোলার বাসিন্দা মো. শাহিনের শয্যাপাশে কেউ ছিলেন না। তাঁর সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা। এ অবস্থা নিয়ে মেঝেতে পড়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর এলেন দুজন। তাঁদের একজন বলেন, আমরা একই জেলার। এখানে তাঁর কেউ নেই।