৯ দিন আন্দোলনের পর সরকারের আশ্বাসে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি। দিনে তিনজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে সড়কে।
সড়ক নিরাপদ করতে ঠিক ছয় বছর আগে বড় আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তখন সরকারের দিক থেকে দুর্ঘটনা কমাতে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরেছিলেন; কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি আজও। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যত মানুষ মারা যান, তাঁদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। এখনো দিনে অন্তত তিনজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে সড়কে।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম নিহত হন। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। টানা ৯ দিন রাজপথে আন্দোলনের পর সরকারের আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যান তাঁরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি সংস্থাগুলো নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছিল। বলেছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রশাসনের খুলে যাওয়া চোখ বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবহনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপদ করার কথা সরকার মুখে যেভাবে বলছে, বাস্তবে সেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কী করণীয়, তা সরকারের জানা। কিন্তু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী নয়।
২০১৮ সালের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর অন্যতম ছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ, লাইসেন্স ছাড়া চালকদের গাড়ি চালানো বন্ধ, শিক্ষার্থীদের চলাচলে পদচারী–সেতুর ব্যবস্থা, দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় গতিরোধক বা স্পিডব্রেকার বসানো, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারের নেওয়া, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা এবং বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে নিহতের ঘটনায় চালকের ফাঁসির সাজার বিধান রাখা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরও সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়নি। স্বয়ং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বিষয়টি নিয়ে দুঃখ করেন। গত বছরের ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের এক অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেন, বাসগুলো দেখলে মনে হয়, এত গরিব গরিব চেহারা। জীর্ণ, মুড়ির টিন চলছে। গায়ে লেখা ‘আল্লাহর নামে চলিলাম’। আর যেতে যেতে পড়ে খাদের মধ্যে অথবা পাশের আইল্যান্ডের ওপর।
তবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী মনে করেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় যেসব আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর অনেকগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে, বাকিগুলো বাস্তবায়নাধীন। গতকাল রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এখনো সড়কে শিক্ষার্থীদের মৃত্যু হচ্ছে, সেটি দুঃখজনক। দুর্ঘটনা কমাতে জনসচেতনতা জরুরি। পাঠ্যপুস্তকে নিরাপদ সড়কের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
সড়কে মৃত্যু কমার বদলে বেড়েছে
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সড়কে মৃত্যু কমার বদলে বেড়ে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩৪ হাজার ৪৭৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় গত সাড়ে পাঁচ বছরে নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৯১৬ শিক্ষার্থী। এই সময়ে দিনে তিনজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন সড়কে। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে ২ হাজার ৬৪১ জন। আর ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৯৭৮ জন।
২০১৯ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৯৩ শিক্ষার্থী নিহত হন। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী মৃত্যু বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৫৩ জনে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই সড়কে ৬১১ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বড় অংশ কর্মক্ষম। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮১ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিরা তাঁদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
আইন ঝুলে আছে, নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তড়িঘড়ি করে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন পাস করে; কিন্তু সেটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের ধর্মঘট ও চাপের মুখে সড়ক আইন পর্যালোচনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও রেলপথমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেন ওবায়দুল কাদের। পরে তাঁরা আইনের সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করেন।
গত ১৩ মার্চ মন্ত্রিসভায় ‘সড়ক পরিবহন (সংশোধন) আইন, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে আইনটির বিভিন্ন ধারায় সাজা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আইনের অন্তত ১২টি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। দুটি ধারা অজামিনযোগ্য থেকে জামিনযোগ্য করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশোধিত আইনটি সংসদে পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়। একাধিক সভা করার পর কমিটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ১৭টি নির্দেশনা দেয়। এগুলোর অধিকাংশই সড়ক শৃঙ্খলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ। কিন্তু ছয় বছরেও এগুলো কাগজে-কলমে আটকে আছে, বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রাজধানীতে অটোমেটিক সিগন্যাল পদ্ধতি চালু করা, ঢাকা শহরের ১৪০টি বাসস্টপেজ চিহ্নিত এবং সুসজ্জিত করা, নির্ধারিত স্টপেজে বাস থামা ও যাত্রী ওঠানামা নিশ্চিত করা, গণপরিবহনে দৃশ্যমান দুটি জায়গায় চালক ও চালকের সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মুঠোফোন নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করা, চলাচলের সময় বাসের দরজা বন্ধ রাখা, পদচারী–সেতুর দুই পাশের ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা এবং ঢাকায় অবস্থিত সব সংস্থার আওতাধীন যানবাহন এবং কর্মচারীদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার মতো বিষয় ছিল।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, একটা গোষ্ঠীর চাপে পড়ে প্রয়োগের আগেই সড়ক আইনটির পোস্টমর্টেম করায় সেটা সমঝোতার দলিল হয়ে গেছে। যাঁরা পরিবহন খাতের সুবিধাভোগী, তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সব কমিটিতে বসে আছেন। এটা একটা বিশাল সিন্ডিকেট।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, সরকার শুধু সড়ক অবকাঠামো তৈরি করেছে, দুর্ঘটনা কমাতে মনোযোগ দেয়নি। দেশে সড়ক ব্যবস্থাপনার ১০ শতাংশ বিজ্ঞানভিত্তিক, বাকি ৯০ শতাংশই রাজনৈতিক। তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সড়কে বিশৃঙ্খলার এই চক্র ভাঙা যাবে না।