স্বামীর চাকরি না থাকায় ৪০ বছর বয়সী মজিদা খাতুন রোজ ঘুম থেকে উঠে ছাত্র পড়ানো শুরু করেন। সকালে নিজের বাসায় একদলকে পড়িয়ে দুপুরে পড়াতে যান ছাত্রদের বাসায়। পড়ানো শেষে বিকেলে তিনি মেয়েকে কোচিং থেকে নিয়ে বাসায় ফেরেন। এরপর সংসারের রান্নাবান্না থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজ করেন। ছাত্র পড়িয়ে সংসারের হাল ধরা মজিদার দিনগুলো এভাবে কাটত।
সেদিনও (৭ এপ্রিল) মজিদা ঘুম থেকে উঠে সকালে ছাত্রদের পড়িয়ে দুপুরে বাসায় গিয়ে পড়ানোর জন্য বের হন। পড়ানো শেষে বিকেল চারটায় বাসায় ফিরে দেখেন, খাটের ওপর পড়ে আছে উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া একমাত্র ছেলে মোদাব্বির রহমানের (১৮) মরদেহ। স্বামী মশিউর রহমান ঝুলে আছেন ফ্যানের সঙ্গে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে (১৩) খাটে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পরে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান মজিদা। চার দিন হয়ে গেল, তাঁর একমাত্র মেয়ে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। স্বামী-সন্তান হারিয়ে অসহায় মজিদা এখন মেয়ের কাছে আছেন।
মজিদা আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলে আমার লেখাপড়ায় ভালো ছিল। তার স্বপ্ন ছিল, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। কিন্তু ছেলে আমার খুন হয়ে গেল। আমার ধারণা, আর্থিক অনটনের কারণে আমার স্বামীই ছেলেকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন। মেয়েকেও খুন করতে চেয়েছিলেন।’
ছেলে ও স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায় মজিদা খাতুন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মু. আহাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার আগে মশিউর বা মোদাব্বিরের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা সম্ভব নয়।
২৩ বছর আগে স্নাতক পাস করা বগুড়ার মজিদা খাতুনের সঙ্গে মশিউর রহমানের বিয়ে হয়। মশিউর বগুড়ার স্থানীয় একটি পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা করেন। বিয়ের তিন মাস পর স্বামীর হাত ধরে মজিদা খাতুন চলে আসেন ঢাকায়। বাসা নেন আগারগাঁওয়ের তালতলা এলাকায়। পরে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন মশিউর। তাঁর বেতনের টাকায় মজিদার সংসার বেশ ভালোভাবে চলছিল। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় মশিউর ও মজিদা দম্পতির প্রথম সন্তানের জন্ম। মজিদা তাঁর নাম রাখেন মোদাব্বির রহমান। এর পাঁচ বছর পর এ দম্পতির একমাত্র কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। দুই সন্তান জন্ম নেওয়ার পর স্বামীর একার আয়ে সংসার চালাতে বেগ পেতে হচ্ছিল এ দম্পতিকে। তখন আবহাওয়া অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে চাকরি পান মজিদা। মাত্র তিন বছর চাকরি করার পর ওই প্রকল্প স্থগিত হয়। এরপর সাত বছর আগারগাঁও এলাকায় কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করেন মজিদা।
এর পর থেকে স্বামী-স্ত্রীর আয়ে সংসার ভালো চলছিল। ২০১৭ সালে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে মশিউর দক্ষিণখানে তিন কাঠা জমি কেনেন। তবে জমি নিবন্ধনের সময় জানতে পারেন, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও ওই জমির নিবন্ধন তিনি পাননি। এরপর করোনাকালে মশিউরের চাকরি চলে যায়। তখন মশিউর একটি আবাসন কোম্পানিতে চাকরি করতেন। অন্যদিকে করোনাকালে মজিদার শিক্ষকতার চাকরিও চলে যায়। পরে মশিউর শেয়ারবাজারে কিছু অর্থ বিনিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে সেখানেও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে মজিদা খাতুন আগারগাঁওয়ের তালতলা এলাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ানো শুরু করেন। একবেলা শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পড়াতেন, আরেক বেলা মানুষের বাসায় গিয়ে পড়িয়ে আসতেন। কোনো কাজ না থাকায় মশিউর বেশির ভাগ সময় বাসায় অবস্থান করতেন। সংসারের নানা কাজে তিনি মজিদাকে সহায়তা করতেন।
মজিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমার স্বামীর কোনো আয় নেই। জমি কেনা বাবদ যে ১৪ লাখ টাকা রতন নামের এক লোককে দিয়েছিলেন, সেই টাকা তিনি প্রতি মাসে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা করে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। তবে তিন মাস ধরে রতন কোনো টাকা ফেরত দিচ্ছিলেন না। এ নিয়ে আমার স্বামী খুব চিন্তিত ছিলেন। প্রায়ই আমাকে আফসোস করে বলতেন, আর বোধ হয় জমি কেনার জন্য দেওয়া টাকা ফেরত পাবেন না।’
মজিদা খাতুন জানালেন, শবে কদরের রাতে তাঁর স্বামী ছেলে মোদাব্বিরকে নিয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন। এরপর গভীর রাতে তাঁরা বাসায় ফেরেন। পরে সবাই একসঙ্গে সাহ্রি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম থেকে ওঠার পর মজিদার কাছে ছাত্ররা পড়তে আসে। সে সময় স্বামী মশিউর বাসার নানা কাজ করেন। বেলা দেড়টার দিকে মজিদা স্বামী, ছেলে ও মেয়েকে ঘরে রেখে ছাত্র পড়ানোর উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। বিকেল চারটার দিকে পড়ানো শেষে তিনি তালতলা এলাকার একটি কোচিং সেন্টারে যান মেয়েকে আনতে। তবে কোচিং সেন্টারে মেয়েকে না পেয়ে বাসায় ফিরে আসেন। কলিং বেল চাপতে শুরু করেন। কলিং বেল বেজে চললেও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাননি। তখন মজিদা তাঁর স্বামীর মুঠোফোনে কল দেন। কিন্তু ফোন আর কেউ ধরে না। তখন মজিদা বাসার তত্ত্বাবধায়ককে এ ঘটনা জানান।
মামলার এজাহারে মজিদা উল্লেখ করেন, ‘কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বাসার জানালা দিয়ে মেয়েকে ডাক দিই। কিন্তু মেয়ের কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। পরে আমি নিজে মই দিয়ে ওপরে উঠে দেখি, মেয়ে আমার অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। দীর্ঘ সময় ডাকাডাকির পর একসময় মেয়ে কিছুটা জ্ঞান ফিরে পায়। তাকে দরজা খুলতে বললেও শরীরে কোনো শক্তি না থাকায় সে দরজা খুলতে পারেনি।’
মামলার এজাহারে মজিদা আরও উল্লেখ করেন, বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের সাহায্যে কাঠমিস্ত্রিকে ডেকে আনার পর শাবল দিয়ে ছিটকিনি খুলে ঘরের ভেতরে ঢোকেন মজিদাসহ অন্যরা। মশিউরকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান। সেই খাটে ছেলে মোদাব্বিরের মরদেহ দেখতে পান তাঁরা। তখন মেয়েকে উদ্ধার করে তাৎক্ষণিকভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেয়েটি হাসপাতালটির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। আজ বুধবার তার চেতনা ফিরেছে। কিন্তু সে কথা বলতে পারছে না।
মামলায় মজিদা বলেছেন, ‘আমার ধারণা, আমার স্বামী মশিউর রহমান সাংসারিক অভাব-অনটনের কারণে আমার ছেলেকে গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করেন। আবার আমার মেয়েকেও গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন।’
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মু. আহাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, মোদাব্বির ও তাঁর বাবা মশিউরের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। মামলার বাদী মজিদা খাতুন জানিয়েছেন, চাকরি না থাকায় মশিউরের আয় ছিল না। আর্থিক অসচ্ছলতা ছিল।
মশিউর জমি কিনে প্রতারিত হয়েছিলেন কি না, তাঁর জানা নেই জানিয়ে ওসি বলেন, পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
মজিদা খাতুন বলেন, প্রতি মাসে ঘরভাড়ার ১৩ হাজার টাকা পরিশোধ করতেন। দুই সন্তানের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে বেগ পেতে হতো। চাকরি না থাকায় স্বামীর ঠিকমতো ঘুম হতো না। মেজাজ থাকত খিটখিটে। সামান্য কারণে মেজাজ হারাতেন।
‘কিন্তু স্বামী নিজের সন্তানকে হত্যা করে ফেলবেন, সেটি কল্পনাও করিনি,’ বলেন তিনি।
মজিদা বললেন, ‘যাদের ঘিরে আমার স্বপ্ন ছিল, তাদের দুজন চলে গেছে। এখন আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন আমার মেয়েটা। আমার মেয়ে কবে সুস্থ হবে, জানি না। আর সুস্থ হলেও তাঁকে কীভাবে মানুষ করব, বলতে পারি না। আমি যদি একটি চাকরি পেতাম, তাহলে মেয়েকে মানুষ করে তুলতে পারতাম।’
আইসিউতে থাকা মেয়েটি ইশারায় জানতে চায়, তার ভাই মোদাব্বির কোথায়, এ তথ্য জানিয়ে মজিদা বলেন, ‘আমার মেয়ের যখন জ্ঞান ফিরবে, তখন কী জবাব দেব তাকে? কীভাবে বলব, তোমার ভাই বেঁচে নেই, বাবাও নেই। ঈদের আগে আমার জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাবে, ভাবিনি কখনো।’