সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীর সমালোচনা

‘তাঁরা যে বেগুন খাবেন, সেটাও খাওয়ার বুদ্ধি নেই’

জাতীয় সংসদে দ্রব্যমূল্য নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ ধরার খবর আসে, কিন্তু বাজারে গেলে দেখা যায়, কেজি ১৬০০-১৮০০ টাকা। সাধারণ মানুষ ইলিশ মাছ, গরুর মাংস খেতে পারেন না। তাঁরা যে বেগুন খাবেন, সেটাও খাওয়ার বুদ্ধি নেই। মজুত থাকার পরও আলুর দাম বেড়ে গেছে। কারণ একটাই, সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট না ভাঙলে নিত্যপণ্যের দাম কমবে না।

দ্রব্যমূল্য ও সিন্ডিকেট নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকার বিশেষ করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কঠোর সমালোচনা করেন বিরোধী দলের সদস্যরা। যার সূত্রপাত হয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী বাণিজ্য সংগঠন (সংশোধন) বিল উত্থাপনের পর। এর আগে গত জুনে বাজেট অধিবেশনেও সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছিলেন তিনি।

বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, দেশে আলু পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত থাকার পরও দাম বেড়ে গেছে। কারণ একটাই, সিন্ডিকেট। বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী মানুষ, তিনি ব্যবসাটা ভালোই বোঝেন। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বহুবার সিন্ডিকেটের কথা অস্বীকার করেছিলেন। মানুষ যখন বলতে শুরু করেছিল বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের হোতা, তখন সত্য কথা বলতে (তিনি) শুরু করলেন যে সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নাম এলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়, এমন মন্তব্য করে গণফোরামের এই সংসদ সদস্য বলেন, দেশের মানুষ জানে ঈদের আগে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, আদার দাম কতগুণ বেড়েছিল। দাম বাড়ার কোনো কারণ ছিল না, এসব পণ্য রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে আসে না।

মোকাব্বির খান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য কাঁচা মরিচ শুকিয়ে রাখা, ডিম সেদ্ধ করে ফ্রিজে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিচ্ছেন। এ পরামর্শগুলো আমরা আগে পেলে খুবই উপকৃত হতাম। কারণ, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।’

মোকাব্বির খান এর আগে সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছিলেন, এটি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের কথা বলেছিলাম। কিন্তু অন্তিম লগ্নে এসে আর পদত্যাগের দাবি করছি না। আমার মনে হয় মন্ত্রী যোগ্য। যোগ্যতা না থাকলে পাঁচ বছর থাকতে পারতেন না।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে, আগামী দিনে মানুষ বলা শুরু করে কি না—জয় সিন্ডিকেটের জয়, সিন্ডিকেটের জয়।’

‘সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া কঠিন’
সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সস্তা আমিষ যেগুলো ছিল, তার দাম অনেক বেড়ে গেছে। ২০২১ সালে পাঙাশের দাম ছিল ১১১ টাকা, এখন ২০০-২৫০ টাকা কেজি। সিন্ডিকেটের কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে নিতে লাখ লাখ, কোটি টাকা মানুষের পকেট থেকে চলে যায়।

বাণিজ্যমন্ত্রীকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। মানুষ হইচই করে। আমরা অস্বস্তিতে পড়ি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বললে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চোখের সামনে চলে আসে। বাচ্চা কোলে নিয়ে মহিলারা টিসিবি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন একটু কম দামের জন্য।’

বাণিজ্য সংগঠন আইন না করে ‘বাণিজ্য সিন্ডিকেট আইন’ করা হলে ভালো হতো—এমন মন্তব্য করে জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, সিন্ডিকেট না ভাঙলে দ্রব্যমূল্য কমবে না। দেশে গরুর মাংস ৮০০ টাকা। ভারতে ২৫০-৩০০ টাকা। ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরার খবর দেখা যায়, কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখা যায় কেজি ১৬০০-১৮০০ টাকা। সাধারণ মানুষ ইলিশ মাছ, গরুর মাংস খেতে পারেন না। তাঁরা যে বেগুন খাবেন, সেটাও খাওয়ার বুদ্ধি নেই।

দ্রব্যমূল্য না কমলে মানুষ বাঁচবে না এমন মন্তব্য করে হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘বাণিজ্যমন্ত্রীর দোষ দিয়ে লাভ হবে কী? উনি ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো বোঝেন। সিন্ডিকেটটা ভালো বোঝেন। সেই জন্য বলছেন, সিন্ডিকেটে হাত দিলে পুড়ে যাবেন। তাই বলি সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া কঠিন, এরা শক্তিশালী মানুষ।’

গত বছরের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের তুলনা করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘বাণিজ্যমন্ত্রী কেন সিন্ডিকেট ধরতে পারছেন না, তা আমরা জানি না।’

দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীকে ব্যবসা ও রাজনীতি—দুই ক্ষেত্রেই ‘সফল’ বলে মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম।

‘হঠাৎ হঠাৎ করে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেন’
বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘এখানে জিনিসপত্রের দাম ও সিন্ডিকেট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বলা হয়েছে আমি নিজে একজন সিন্ডিকেটের লিডার। আমি ব্যবসায়ী। দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই সংসদে আমার অনেকবার বলতে হয়েছে যে আমি ব্যবসায়ী হওয়ার অনেক আগে থেকেই রাজনীতি করি। আমি রাজনীতি শুরু করার ২০ বছর পরে ব্যবসা শুরু করেছি।’

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যবসা করাটা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে আমি সেই অপরাধে অপরাধী। হয়তো ব্যবসা না করলে এদিক সেদিক থেকে চাঁদা নিয়ে আমাকে বাঁচতে হতো। আমি যে ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তা দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আমি বিদেশে রপ্তানি করি।’

বৈশ্বিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি এবং কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কখনো হঠাৎ হঠাৎ করে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেন।

লাখ লাখ ডিম উৎপাদনকারীকে আমরা কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রণ) করব কীভাবে—এমন প্রশ্ন রেখে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সে দামে ডিম বিক্রি করা না হলে দু-এক দিনের মধ্যে সরকার ডিম আমদানি করবে।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, তাঁদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। তিনি সংসদ সদস্যদের পরামর্শও নেবেন। কিন্তু যে চেষ্টা করছেন, সেটা স্বীকার করে উৎসাহ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

পরে বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি শেষে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। নির্ধারিত সময়ে বাণিজ্য সংগঠনের নির্বাচন করা না গেলে অতিরিক্ত ছয় মাস সময় পাওয়া যায় এখন। বিলে সংশোধনী এনে সেটি আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে।