চট্টগ্রামে গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের কারখানা। সম্প্রতি তোলা
চট্টগ্রামে গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের কারখানা। সম্প্রতি তোলা

সরকারি প্রতিষ্ঠান: ফিরে দেখা—২

লোকসানে বিএসইসির আরও দুই প্রতিষ্ঠান

‘বেসরকারি খাত ভালো করছে, ধুঁকছে বিএসইসি’ শিরোনামে ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অবস্থা আজকের প্রতিবেদনে। এর আগে ১৯ জানুয়ারি ‘ফিরে দেখা’ প্রকাশিত হয়েছিল বিটিএমসি নিয়ে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার সুপারমার্কেটে ইলেকট্রনিক পণে৵র সাত-আটটি দোকান ঘুরে কোনোটিতেই গাজী ওয়্যারসের বিদ্যুতের তার পাওয়া যায়নি। এই প্রতিষ্ঠান তার উৎপাদন করে, তা অনেক দোকানি জানেন না। অথচ বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) এই প্রতিষ্ঠান ৫৫ বছরের বেশি সময় ধরে তার উৎপাদন ও বিপণন করছে।

রাজধানীর এই বিপণিবিতানে মাত্র দুজন দোকানি জানান, তাঁরা একসময় গাজী ওয়্যারসের তার বিক্রি করতেন। এখন আর রাখেন না। কেউ চাইলে গুলিস্তানের নবাবপুর পাইকারি বাজার থেকে এনে দেন। তাঁদের একজন সুপার ইলেকট্রনিকসের মালিক নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, গাজী ওয়্যারসের চেয়ে ভালো মানের তার বাজারে নেই। সব ধরনের তারই তাদের আছে। কিন্তু ওদের কোনো বিক্রয় প্রতিনিধি দোকানে আসেন না।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএসইসির প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদু৵তের তার উৎপাদন করে গত কয়েক বছর ধরে তারা লাভে ছিল। এবার করপোরেশনের লোকসানি প্রতিষ্ঠানের কাতারে যোগ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১–২২ অর্থবছরে এসে তারা তিন কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে। নতুন করে লোকসানে পড়েছে আরেক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টিউবস।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকায় গাজী ওয়্যারসের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির দুটি কারখানা রয়েছে। এর একটি পুরোনো, অন্যটি নতুন। দুটি কারখানাই চালু আছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত ২০ জানুয়ারি থেকে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

* বিএসইসির মোট ৯ প্রতিষ্ঠানের ৫টিই এখন লোকসানে। * বাজারে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের পণ্য পাওয়া যায় না। * তিন বছর ধরে বিএসইসির আয়–ব্যয় সমান।

লাভজনক প্রতিষ্ঠান হঠাৎ কেন লোকসানে পড়ল—এমন প্রশ্নে গাজী ওয়্যারসের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মনিরুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে আমাদের প্রধান গ্রাহক ছিল বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। মান ভালো বলে আমাদের পণ্যের দাম বেশি পড়ে। অল্প লাভে তাদের কাছে মাল বিক্রি করতাম। এখন বিআরইবি বাজার থেকে কম দামে নিম্ন মানের তার কিনছে। এতে আমরা লোকসানে পড়েছি।’

বিকল্প বাজার খোঁজার চেষ্টা করছেন কি না, জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান খান বলেন, ‘আমাদের এখন প্রধান ক্রেতা বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠান, তবে তাদের চাহিদা কম। সাধারণ মানুষ আমাদের পণ্যের মূল্য বোঝে না। আবার অর্থের অভাবে গ্রাহক আকৃষ্ট করতে বেশি প্রচার–প্রচারণা চালাতে পারছি না।’

শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিএসইসির লোকসানি কারখানার সংখ্যা বেড়েছে। গত অর্থবছর পাঁচটি কারখানা লোকসান দিলেও আগের বছর লোকসানে ছিল চারটি।

বিএসইসি বর্তমানে নয়টি কারখানা চালায়। এর মধ্যে পাঁচটি লোকসানে এবং চারটি লাভে আছে। এ ছাড়া বিএসইসির তিনটি কারখানা যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়। করপোরেশনটির আরও অন্তত ছয়টি কারখানা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে।

বিএসইসির চেয়ারম্যান মো. শহীদুল হক ভূঁঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর পাঁচটি কারখানা লোকসান করলেও বাকিগুলো লাভে ছিল। সব মিলিয়ে আর্থিকভাবে ভালো করছি।’

পাইপের কারখানাও লোকসানে

টানা লাভে থাকা বিএসইসির প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টিউবস লিমিটেডও গত অর্থবছরে নতুন করে লোকসানে পড়েছে। ধাতব পাইপ উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠান গত অর্থবছরে ৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

ন্যাশনাল টিউবসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম আনোয়ার মোর্শেদ বলেন, কয়েক দফায় দরপত্র আহ্বান করেও কাঁচামাল পাওয়া যায়নি। কাঁচামালের অভাবে পাঁচ–ছয় মাস কারখানার উৎপাদন বন্ধ ছিল। এ কারণেই লোকসানে পড়েছে। সেই সংকট এখন নেই।

টানা লোকসানে আরও তিন কারখানা

মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএসইসির তিনটি কারখানা বেশ কয়েক বছর ধরে টানা লোকসান দিচ্ছে। তার একটি এটলাস বাংলাদেশ লিমিটেড। গত তিন অর্থবছরে কারখানাটি ১৯ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে দেশে মোটরসাইকেল সংযোজন করে এটলাস।

কর্মকর্তারা বলেন, ২০১৪ সালের দিকে হোন্ডার সঙ্গে চুক্তি শেষ হওয়ার পর থেকে মোটরসাইকেল উৎপাদন প্রায় বন্ধ। যেসব ভালো ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল আছে, তার কটিরই দেশে বিপণন প্রতিষ্ঠান আছে। নতুন প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় এটলাস লোকসানে।

এটলাসের এমডি (ভারপ্রাপ্ত) মো. আজিবর রহমান বলেন, হোন্ডা চলে যাওয়ার পর টিভিএসের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়। তাতে এই প্রতিষ্ঠানের ছয় থেকে সাত হাজার মোটরসাইকেল সরকারি খাতে বিক্রি হয়। করোনার কারণে সরকার কেনা বন্ধ রেখেছে।

এমডি বলেন, চলতি বছরের মার্চে একটি বিদ্যুতের ও একটি পেট্রোলচালিত মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এটলাসের চুক্তি হতে পারে। সেটি হলে এটলাস লাভের মুখ দেখতে পারে।

টানা লোকসানে থাকা আরেকটি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন টিউবস লিমিটেড। বৈদ্যুতিক বাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি গত ৩ অর্থবছরে ৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির এমডি মো. নাজমুল হকনপ্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মান বজায় রাখি বলে লাভে যেতে পারছি না। ভালো পণ্য তৈরি করতে গেলে স্বাভাবিকভাবে খরচ বেড়ে যায়।’

কারওয়ানবাজার সুপারমার্কেটের ইলেকট্রনিকের নয়টি দোকান ঘুরে মাত্র দুটিতে ইস্টার্ন টিউবসের বাতি পাওয়া যায়। শহীদ ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্কসের কর্ণধার বলেন, বাজারে এখন এলইডি বাতির চাহিদা। কিন্তু ইস্টার্ন টিউবসের বাতি সাধারণ। তাই মানুষ কম নেয়। তাদের কোনো বিক্রয় প্রতিনিধিও আসেন না।

প্রতিষ্ঠানটির এমডি নাজমুল হক বলেন, ‘বড় বড় প্রতিষ্ঠান আমাদের ক্রেতা। বাজারে পণ্য ছড়িয়ে দিতে নতুন নতুন ডিলার নিয়োগের চেষ্টা চলছে।’

বাংলাদেশ ব্লেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড গত তিন অর্থবছরে প্রায় ১২ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।

তিন বছর ধরে বিএসইসির আয়–ব্যয় সমান

শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে গত অর্থবছর বিএসইসির আয় দেখানো হয় ১৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ব্যয়ও দেখানো হয় ১৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আগের দুই অর্থবছরেও আয়–ব্যয় সমান দেখানো হয়েছে।

আয়–ব্যয় কীভাবে এক হচ্ছে, জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান শহীদুল হক বলেন, ‘এটা ভুল তথ্য হতে পারে। কারণ, গত অর্থবছরে আমরা প্রায় ৪৭ কোটি টাকা লাভ করেছি। বিষয়টি যাচাই করে জানানো হবে।’ তবে করপোরেশনের পক্ষ থেকে আর কোনো হালনাগাদ তথ্য পাওয়া।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন, চট্টগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক, সুজন ঘোষ]