‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক: নদী, সীমান্ত ও বিদ্যুৎ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা। শনিবার ভার্চ্যুয়ালি এই সংবাদ সম্মেলন হয়
‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক: নদী, সীমান্ত ও বিদ্যুৎ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা। শনিবার ভার্চ্যুয়ালি এই সংবাদ সম্মেলন হয়

ভারতের সঙ্গে কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহার চুক্তি খারাপ দৃষ্টান্ত

দেশের ভেতরে কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি তুলতে ভারতের অনুমতি নেওয়ার চুক্তি করে একটি ভুল ও খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। এ চুক্তির কারণে এখন থেকে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ নদীগুলো থেকে বাংলাদেশ পানি উত্তোলন করতে চাইলে ভারত হস্তক্ষেপ করতে পারে। ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক: নদী, সীমান্ত ও বিদ্যুৎ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেছেন। আজ শনিবার সকালে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ‘সর্বজনকথা’ নামের একটি সাময়িকী।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ আইনে সই করা। আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমেই দেশের সব যৌথ নদীর পানিবণ্টনসহ সার্বিক সমস্যার সমাধান করা।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. খালেকুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে ১৫৩ কিউসেক পানি তোলার জন্য ভারতের কাছে অনুমতি চাওয়া প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশ দেনদরবার করতে পারত যে কুশিয়ারা নদীর ভারত অংশে তারা খাল বন্ধ করে দিয়েছে, বেশ কিছু সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প করেছে, যার অভিঘাত বাংলাদেশে পড়ছে ও পড়বে। এসবের জন্য ভারত বাংলাদেশের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। এই যে চুক্তি করা হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পানি ব্যবস্থাপনার জন্য, এটা ভুল ও খারাপ একটি দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ স্থাপন করল। এর পর থেকে দেশের যেকোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ পানি ব্যবস্থাপনা করতে গেলে ভারত বলতে পারে, বাংলাদেশের ভেতরে হলেও এর অভিঘাত ভারতেও পড়বে। কারণ, এটা যৌথ নদীর অংশ।

খালেকুজ্জামান বলেন, এখন ভারত যদি বলে, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ১৫৩ কিউসেক পানি নিতে পারবে, বাকি পানি ভারতের। এ চুক্তির অজুহাতে ভারত বাকি পানি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলে বাংলাদেশ কী করবে, সে বিষয়ে চুক্তিতে কিছু উল্লেখ আছে কি না, তা জানতে চান তিনি।

এই চুক্তি ন্যায্য ও সঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেন মো. খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, এ চুক্তিতে পুরো অববাহিকার পানি ও পলি কীভাবে ব্যবস্থাপনা হবে, তার উল্লেখ নেই। চুক্তিতে এমন কোনো বিধান নেই, ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে যে পরিবেশগত ক্ষতি করা হয়েছে, তার জন্য তারা ভর্তুকি বা ক্ষতিপূরণ দেবে কি না। ভবিষ্যতে এ রকম প্রকল্প নিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তারা বাংলাদেশের সঙ্গে বোঝাপড়া করবে কি না।

উন্নয়নের জোয়ার বেশি বোঝানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৫৩ কিউসেক পানি দিয়ে ১০ হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদের কথা বলেছে। আসলে এই পানি দিয়ে ৩ হাজার ৭০০ হেক্টরের বেশি জমি চাষাবাদ করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, কুশিয়ারার পানি ব্যবহার করতে হলে তা সেচ দিয়ে উজানে নিতে হবে, যা যুক্তিসংগত নয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ বলেন, কী করে মাত্র ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার, তা-ও বাংলাদেশের নদীর পানি বাংলাদেশ প্রত্যাহার করবে, এর জন্য ভারতের অনুমতি কেন নিতে হবে, এটা একেবারেই বোধগম্য নয়। এটাকে কী করে সরকার সাফল্য হিসেবে দেখাতে পারে? কুশিয়ারার ওপর ভারত বাঁধ ও বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প করেছে। সে জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে তারা কোনো ধরনের অনুমতি নেয়নি।

আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ আইনে বাংলাদেশ কেন স্বাক্ষর করেনি, তা বোধগম্য নয় উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ভাটির দেশ হিসেবে এটা বাংলাদেশের জন্য খুব দরকার। ভাটির দেশগুলোর নিরাপত্তার একটি সনদ বলা যায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি আইনকে। এ আইনে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই সই করতে হবে। ভারতও যেন সই করে, সে জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতসহ অন্য দেশগুলোর যৌথ নদীর সব সমস্যা যথাযথভাবে নিষ্পত্তি করার দাবি জানান তিনি।

সীমান্ত হত্যার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত, জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে জোর দেওয়া এবং ভারতের সঙ্গে এবার ট্রানজিট বিষয়ে কী চুক্তি হয়েছে, তা স্পষ্ট করার দাবিও জানান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজীম উদ্দিন খান বলেন, ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সীমান্তে ১ হাজার ২৫৩ জন বাংলাদেশি হত্যার শিকার হয়েছেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় তা অব্যাহত আছে।

ভারতের ওপর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিনির্ভরতা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা। তিনি বলেন, ভারতীয় প্রকল্পগুলো (বাংলাদেশ ও ভারতে) বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ভারতের অংশগ্রহণ দাঁড়াবে প্রায় ১৬ শতাংশ। এর সঙ্গে নির্মিতব্য পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আমদানি শুরু হলে জ্বালানি খাতে ভারতের অংশগ্রহণ ২০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারতের ওপর নির্ভরতা তৈরি হলে তারা দেশকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাবে।