সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর সংঘাতে আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে সুদানের রাজধানী খার্তুম। এর মধ্যে সেখানে লুটপাটের শিকার হয়েছেন ৫৯ বাংলাদেশি। সবকিছু হারিয়ে তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। উৎকণ্ঠায় থাকা এসব মানুষ এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন।
এই বাংলাদেশিরা খার্তুমের সোবা এলাকায় দেশটির তোলান ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানা চত্বরে থাকতেন। প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুতের খুঁটি ও মুঠোফোন টাওয়ার নির্মাণ করে। কারখানা প্রাঙ্গণের মধ্যে দুটি ভবনে থাকতেন ওই বাংলাদেশিরা।
স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার বিকেলে স্থানীয় ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ লোক লাঠি, দা, ছুরি নিয়ে সেখানে হামলা চালান। তাঁরা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে টাকা, মুঠোফোন ও মূল্যবান জিনিসের পাশাপাশি রান্না করা খাবার ও হাঁড়ি–পাতিলও নিয়ে গেছেন।
লুটপাটের শিকার হওয়া বিল্লাল হোসেন ও মোতালেব হোসেন নামের দুই বাংলাদেশি আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে খার্তুমের সোবা থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানান। বিকেলে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সুদানের রাজধানী খার্তুম ও আশপাশের এলাকায় অবস্থানরত আরও ছয় বাংলাদেশির সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। পেশায় ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী এসব বাংলাদেশি জানান, বৃহস্পতিবারও বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে গোলাগুলি ও রকেট হামলার পাশাপাশি জঙ্গি বিমান উড়তে দেখা গেছে। অর্থাৎ, মার্কিন মধ্যস্থতায় গত মঙ্গলবার থেকে যে অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল, তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, সুদানের সেনাবাহিনী ও র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে লড়াই অব্যাহত থাকায় এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা সুদান ছেড়ে গেছেন। এর পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনও খার্তুম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়া খার্তুমে বাংলাদেশের লোকজনের মধ্যে দ্রুত সুদান ছাড়ার তাগিদ বাড়ছে। এর মধ্যে গতকাল বিকেলে খার্তুমের সোবা শিল্প এলাকায় বাংলাদেশিরা লুটপটের শিকার হওয়ায় আতঙ্ক আরও বেড়েছে। ওই লুটপাটের ঘটনায় লড়াইরত কোনো পক্ষ নয়, স্থানীয় লোকজন জড়িত।
এই লুটের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের দিন মঙ্গলবার স্থানীয় অন্তত শ খানেক লোক এসে দুই দফা হামলার চেষ্টা করে। ওই দিন ব্যর্থ হওয়ার পর বুধবার বিকেলে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ স্থানীয় লোক ফটক ভেঙে কারখানা চত্বরে ঢুকে পড়ে। তাদের মনোভাব দেখে আমরা টাকা, মুঠোফোন, জামাকাপড়সহ সবকিছু দিতে বাধ্য হই। সুদানিরা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জিনিস দিয়ে দেওয়ায় তারা আমাদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করেনি। লুটপাটের সময় তারা আমাদের খাবার, থালাবাসন ও হাঁড়ি–পাতিলসহ সবকিছু বস্তায় ভরে নিয়ে গেছে। এর পর থেকে আমরা খোলা আকাশের নিচে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।’ তিনি জানান, লুটপাটের সময় স্থানীয় সুদানিরা কারখানা কর্তৃপক্ষের লকার ভেঙে টাকাপয়সা নিয়ে গেছে।
খার্তুম বিমানবন্দরের কাছে বাংলাদেশ টেইলার্সের মালিক হাবিব শেখ আজ বিকেলে জানান, কারখানায় লুটপাটের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁর এক বন্ধু রয়েছেন। ওই ৫৯ বাংলাদেশি গতকাল বিকেল থেকে রীতিমতো এক কাপড়ে না খেয়ে আছেন। এ মুহূর্তে তাদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়াটা জরুরি। এ জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসের সক্রিয় ভূমিকা রাখা দরকার।
খার্তুমের অবনতিশীল পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে হাবিব শেখ বলেন, এখানে প্রতিনিয়ত যেভাবে একে অন্যের ওপর হামলা চালাচ্ছে, তাতে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।
১৯ এপ্রিল ঈদের দিন এক হামলার কথা তুলে ধরে হাবিব শেখ বলেন, ওই দিন দোকানের আট কর্মচারী তাঁর বাসায় দাওয়াত খেতে এসেছিলেন। পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় সেদিন তাঁরা থেকে যান। পরদিন ওই কর্মচারীরা তাঁদের বাসার কাছে গিয়ে দেখেন, ভবনটি বিধ্বস্ত। বোমা হামলায় সেখানে ইথিওপিয়ার চার নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। আর ছয়জন গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁদের সবার অবস্থা সংকটাপন্ন।
‘সেই রাতে বাসায় ফিরলে আমার দোকানের কর্মচারীদের পরিণতিও এমন হতে পারত,’ বলেন এই বাংলাদেশি ব্যবসায়ী।