রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে আইন লঙ্ঘন করে নির্বিচার প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলটি যখন পার্কের মোড়ে যায়, তখন সবার সামনে ছিলেন আবু সাঈদ। পুলিশের বাধার মুখে অন্যরা সরে গেলেও আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। একা নিরস্ত্র প্রতিবাদী এই তরুণকে একের পর এক গুলি করে পুলিশ। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

শুধু রংপুর নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচার গুলি করেছে। এর মধ্যে অন্তত তিন শ্রেণির প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করার তথ্য পাওয়া গেছে। ১৬ জুলাই থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন পর্যন্ত যে বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৭৫৮ জনের নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন প্রাণঘাতীর অস্ত্রের গুলিতে। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির হিসাবে ৭০ শতাংশ মৃত্যুই হয়েছে গুলিতে।

রংপুরে আবু সাঈদকে গুলির ওই ঘটনার দুটি ভিডিও যাচাই করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব। সংস্থাটি জানিয়েছে, স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে তারা দেখেছে, ১৫ মিটার দূর থেকে আবু সাঈদকে গুলি করা হয়। সাঈদ তখন পুলিশের জন্য কোনো হুমকির কারণ ছিলেন না। আপাতদৃষ্টে ওই গুলির ঘটনা ইচ্ছাকৃত ছিল।

এ রকম আরও ছয়টি ঘটনার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছে তথ্য যাচাইকারী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তাতে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ প্রয়োগের মতো পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৩৪১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৩৭ জনের শরীরে প্রাণঘাতী গুলি ও ২২ জনের শরীরে শটগানের গুলির চিহ্ন ছিল। তাঁদের অনেকে ‘এইম ফায়ার’ বা লক্ষ্যবস্তু করে গুলির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

৪ আগস্ট থেকে পরের সময়ে আরও ৪১৭ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে এখন পর্যন্ত। এর মধ্যে ৪ আগস্ট এক দিনেই সারা দেশে নিহত হন ১১৬ জন। ওই দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ প্রয়োগের মতো পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলায় অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে শটগান, বন্দুক ও পিস্তল বেশি দেখা গেছে। কোথাও কোথাও রাইফেলও দেখা গেছে। ফেনীতে সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর অনুসারীরা একে-৪৭ ও এম-১৬ রাইফেল দিয়েও গুলি করেছেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালানোর পর অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং থানায় ও পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ৫ আগস্ট আক্রান্ত বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশও অনেক গুলি করেছে। পুলিশের ভাষ্য, তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি করতে বাধ্য হয়েছে।

তবে আন্দোলনকারীরা বলছেন, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই বিভিন্ন স্থানে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে। সবচেয়ে বেশি গুলির ঘটনা ঘটেছে যাত্রাবাড়ীতে। এ ছাড়া থানায় হামলার ঘটনা বাদ দিলে ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গুলিবর্ষণ করেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র, গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন হাসপাতাল ও তথ্য যাচাইকারী একাধিক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের তথ্য এবং সংঘর্ষের সময় ব্যবহৃত অস্ত্রের ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার ক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও চাইনিজ রাইফেল—এই তিন শ্রেণির অস্ত্রের ব্যবহার বেশি হয়েছে। কোথাও কোথাও এসএমজি ও এলএমজির মতো অস্ত্রও ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানের গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, শটগান থেকে রাবার ও সিসার দুই ধরনের গুলি ব্যবহার হয়েছে। এই গুলিগুলোকে ছররা গুলিও বলে থাকেন অনেকে। কারণ, এর কার্তুজের ভেতরে ছোট ছোট বল (স্প্লিন্টার) থাকে। বলের সংখ্যা, আকার ও লক্ষ্যবস্তুর দূরত্বভেদে ছররা গুলিও প্রাণঘাতী হতে পারে। যেমনটা ঘটেছে রংপুরের আবু সাঈদের ক্ষেত্রে। মৃত্যুর পর দেখা গেছে, স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে তাঁর বুক ও পেট ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, এখন পুলিশ বাহিনীতে ৭ পয়েন্ট ৬২ এবং ৯ এমএম ক্যালিবারের অস্ত্রের ব্যবহার আছে। তবে ৯ এমএম পিস্তলের ব্যবহারই বেশি। এ ছাড়া পুলিশের কাছে ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চাইনিজ রাইফেল, সাব মেশিনগান (এসএমজি) ও লাইট মেশিনগান (এলএমজি) রয়েছে।

গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ একজন অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৯ এমএম পিস্তলের গুলির কার্যকর সীমা (ইফেক্টিভ রেঞ্জ) ৫০ মিটার। তবে অবস্থাভেদে কয়েক শ মিটার দূরত্বে আঘাত করলেও তা প্রাণঘাতী হতে পারে। আধা স্বয়ংক্রিয় (সেমি-অটোমেটিক) ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চাইনিজ রাইফেলের গুলি ৩০০ মিটারের মধ্যে কারও শরীরে লাগলে তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।

আর কার্তুজের ধরনের ওপর নির্ভর করে শটগানের গুলি ৪০-৫০ মিটারের মধ্যে লাগলে প্রাণনাশের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব বেশ কয়েকটি গুলির ঘটনা যাচাই করে জানিয়েছে, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলির বেআইনি ব্যবহার করেছে। একে অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের নির্বিঘ্ন ব্যবহার হয়েছে।

এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের জন্য গ্যাস গান, সাউন্ড গ্রেনেড ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁদানে গ্যাসের শেলও ছিল। এমনকি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ওপর থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করারও অভিযোগ রয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, আবদ্ধ স্থানে থাকা অবস্থায়ও শিক্ষার্থীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের বিপজ্জনক ব্যবহার হয়েছে।

র‌্যাব জানিয়েছে, ১৭ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত তাদের একটি হেলিকপ্টারই ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ৯৮ বার উড্ডয়ন করেছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তাঁদের হেলিকপ্টার থেকে শুধু সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে, কোনো গুলি করা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও গুলি করেছেন, তাতে বাংলাদেশের সংবিধান, দণ্ডবিধি ও পুলিশ প্রবিধানসহ প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিরও লঙ্ঘন।

পদে পদে আইন লঙ্ঘন

পুলিশ প্রবিধানের ১৫৩ ধারা অনুযায়ী, তিন ক্ষেত্রে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। এগুলো হলো ব্যক্তির আত্মরক্ষা ও সম্পদ রক্ষার অধিকার প্রয়োগ, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা ও গ্রেপ্তার কার্যকর করার জন্য।

দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ১০০ ও ১০৩ ধারা অনুযায়ী, প্রাণহানি, মারাত্মক আঘাত ও অগ্নিসংযোগের দ্বারা অনিষ্ট করাসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশকে আক্রমণকারীদের মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) ১৫৩-তে বলা হয়েছে, নিজেদের বা জনগণের সরকারি সম্পত্তি হামলা থেকে রক্ষার জন্য পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।

তবে দণ্ডবিধির ৯৯ ধারায় এই শক্তি প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, আত্মরক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না। তা ছাড়া দণ্ডবিধির ১০২ ধারা অনুযায়ী, যখনই ক্ষতির আশঙ্কা শেষ হবে, তখনই আত্মরক্ষার জন্য শক্তি প্রয়োগের অধিকারও শেষ হবে।

রাজধানীর রামপুরা এলাকার একটি ভিডিও ফুটেজ যাচাই করে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির বাংলাদেশ ফ্যাক্ট চেক এডিটর কদরুদ্দীন শিশির প্রথম আলোকে বলেন, রামপুরা-মৌচাক সড়কের ওয়াপদা রোডের মুখে বিক্ষোভরত এক যুবক হঠাৎ করে পড়ে যান। গুগল স্ট্রিট ভিউ থেকে নেওয়া ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১০০ মিটার বা তার কিছু দূরে থাকা বিজিবি দলের অবস্থান থেকে ছোড়া একটি বুলেট ওই যুবকের শরীরে লাগে।

ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার ক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও চাইনিজ রাইফেল—এই তিন শ্রেণির অস্ত্রের ব্যবহার বেশি হয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব এই এলাকার একটি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গত ২৫ জুলাই জানিয়েছে, এতে পুলিশ ও বিজিবির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে একটি সাঁজোয়া যানের (এপিসি) পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। একজন কর্মকর্তা একটি অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে দুটি গুলি করেন।

ভিডিওটি যাচাই করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র সমাবেশের পুলিশিংয়ের জন্য উপযুক্ত হাতিয়ার নয়। মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের আসন্ন হুমকির মোকাবিলায় কঠোরভাবে প্রয়োজন হলেই কেবল এমন অস্ত্র ব্যবহার করা উচিত।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো বিক্ষোভ বা রাস্তায় নেমে আসা বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ধৈর্য নিয়ে কাজ করতে হয়। কাউকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গুলি করা পুলিশের কাজ নয়। তা ছাড়া ঘর, বারান্দা ও ছাদে থাকা মানুষের শরীরে গুলি লেগেছে, কেউ কেউ মারা গেছেন—এগুলো খুবই ভয়ংকর অপেশাদার কাজ।

সাবেক এই আইজিপির মতে, এখন পুলিশে পেশাদারত্বের কাজের চেয়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বেশি হয়ে গেছে। এ কারণে এগুলো হয়েছে। তা না হলে এভাবে গোলাগুলি করার কোনো কারণ নেই। পেশাদারত্বের জায়গা থেকে পুলিশ অন্যদিকে সরে গিয়েছিল।

‘চরম ব্যবস্থার’ অপব্যবহার

কোনো সমাবেশ যদি বেআইনিও হয়, তাহলে তা ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি করার আগে হুঁশিয়ারি (ওয়ার্নিং) দেওয়ার বিধান রয়েছে পুলিশ প্রবিধানে। প্রবিধান ১৫৩ (গ)-তে বলা হয়েছে, ‘সকল প্রকার চেষ্টা ও ব্যবস্থার পরেও যখন জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তখন সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে।’ তবে পিআরবিতে এটিকে ‘চরম ব্যবস্থা’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

তবে স্থানীয়দের বর্ণনা ও বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভ ও সংঘাত চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপরও অনেক গুলি করেছে। তারা ‘চরম ব্যবস্থার’ অপব্যবহার করেছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা ঢাকার ৩১টি হাসপাতাল ঘুরে দেখেছেন, ১৬ থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে এই হাসপাতালগুলোয় আহত ৬ হাজার ৭০৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে ১৮ থেকে ২২ জুলাই ভর্তি হয়েছিলেন ৯৬৪ জন। তাঁদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ছিলেন ২৩১ জন।

পুলিশ প্রবিধান ১৫৪-তে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গুলি সব সময় নির্ধারিত লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতে হবে; একেবারে অপরিহার্য ব্যতীত কোনোরূপ বড় রকমের ক্ষতি সাধন করা যাবে না এবং উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ামাত্রই গুলি বন্ধ করতে হবে।’

কীভাবে গুলি করা যাবে, সে বিষয়েও পুলিশ প্রবিধানের ১৫৫-তে আছে, ‘গুলি চালানোর নির্দেশদানকারী কর্মকর্তা গুলিবর্ষণকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন, যাতে সর্বনিম্ন ক্ষতিসাধন করে দ্রুত উদ্দেশ্য পূরণ করা যায়। সমবেত জনতার মাথার ওপর দিয়ে অথবা সমাবেশে থাকা ব্যক্তিদের বাইরে অন্য কোনো লক্ষ্যে গুলি করা কঠোরভাবে নিষেধ। কারণ, এতে দূরবর্তী নিরপরাধ লোক হতাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার আগে দূরত্ব, লক্ষ্য ও গুলির সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।’ তা ছাড়া জনতার সরে যাওয়া ও ছত্রভঙ্গ হওয়ার সামান্যতম প্রবণতা থাকলেও গুলি চালানো বন্ধের নির্দেশনা আছে পিআরবিতে।

কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশ প্রবিধানের এসব নির্দেশনা মানা হয়নি। যার কারণে বাসার ভেতরে, বারান্দায় ও ছাদে থাকা অবস্থায়ও অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ঢাকার কেবল তিনটি হাসপাতালেই ৬১৫ জন চোখে ছররা গুলি ও রাবার বুলেটবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

যাত্রাবাড়ী এলাকার চারটি ভিডিও ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, পুলিশ খুব কাছাকাছি দূরত্বে থেকে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করছে। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে সড়ক বিভাজনের পাশে লুকিয়ে থাকা বিক্ষোভকারীদের খুঁজে খুঁজে গুলি করার দৃশ্য রয়েছে। আরেকটি ভিডিওতে গুলিতে মৃতপ্রায় একজনকে সরিয়ে নেওয়ার সময় কয়েক পুলিশ সদস্যকে দুই ব্যক্তির ওপর নির্বিচার গুলি করতে দেখা যায়। আরেক ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে ব্যাপক মারধর করে চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ এক পুলিশ সদস্য গুলি করে বসেন। মুহূর্তে ওই ব্যক্তি লুটিয়ে পড়েন। আরেকটি ভিডিওতে অস্ত্রের নল ঠেকিয়ে এক ব্যক্তিকে গুলি করতে দেখা গেছে। এই চার ঘটনার কোনোটিতেই পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার মতো অবস্থায় দেখা যায়নি।

এমন পরিস্থিতিতে ১১ আগস্ট পুলিশের চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন করেছেন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. মনিরুজ্জামান। তিনি সেখানে লিখেছেন, গত ১০ বছরে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের অবৈধ আদেশ পালন করতে হয়েছে। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের হিংস্র ও বর্বর আদেশে শিশু-কিশোরসহ বহু মানুষকে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা হত্যা করেছেন।

নিরস্ত্র মানুষকেও গুলি

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, নির্মাণাধীন একটি ভবনের কার্নিশে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিকে পরপর কয়েকটি গুলি করা হচ্ছে। এই ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এএফপির বাংলাদেশ ফ্যাক্টচেক এডিটর কদরুদ্দীন শিশির প্রথম আলোকে বলেন, রামপুরার নির্মাণাধীন ভবনটিতে ঝুলে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন একজন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে।

পরে ওই ব্যক্তির সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁর নাম আমির হোসেন, বনশ্রীর মেরাদিয়ায় থাকেন। পেশায় দোকানকর্মী। ওই দিন বাসায় ফেরার সময় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে তিনি ওই নির্মাণাধীন ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে পুলিশ তাঁর দুই পায়ে ছয়টি গুলি করে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্রেপ্তারের জন্য হলেও নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে গুলি করা যায় না।

পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কতিপয় উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে এবং কর্মকৌশল প্রণয়নে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এতে জড়িতদের শনাক্ত ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

‘মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধাবস্থা’

জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার থাকবে। এ ঘোষণাপত্রের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে নির্যাতন করা যাবে না কিংবা কারও প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না।

এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার আগে ৩ আগস্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি বলেন, ‘নিরস্ত্র মানুষের ওপর অপ্রয়োজনীয়ভাবে যত্রতত্র, ডানে-বাঁয়ে, যেদিকে মনে চায়, সেদিকেই গুলি করা হয়েছে। প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এর চেয়ে বিশৃঙ্খল এবং অনিয়ন্ত্রিত গুলিবর্ষণের ঘটনা আমি আর দেখিনি। এ সময় হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধাবস্থা।’

উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১ আগস্ট এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক হয়নি।

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, ১৯৬৬-তে বাংলাদেশ ২০০০ সালে স্বাক্ষর করে। এ কারণে চুক্তিটি পালনে বাংলাদেশের আইনত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই চুক্তির ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের বাঁচার সহজাত অধিকার রয়েছে। এ অধিকার আইনের দ্বারা রক্ষিত হবে। কোনো ব্যক্তিকে খেয়ালখুশিমতো জীবন থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।