আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বক্তারা। আজ রোববার এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর সম্মেলনকক্ষে
আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বক্তারা। আজ রোববার এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর সম্মেলনকক্ষে

তথ্য কমিশন ও তথ্য অধিকার আইনের সংস্কার প্রয়োজন

নিপীড়ন ও নির্যাতনের জন্য তথ্য গোপন রাখাকে একটি মোক্ষম কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তথ্য অধিকার নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি আছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি তথ্য কমিশন সংস্কার ও তথ্য অধিকার আইনে সংশোধন আনা প্রয়োজন।

আজ রোববার আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তথ্য অধিকার: এনজিওদের সহায়ক ভূমিকা’ শীর্ষক এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ও তথ্য অধিকার ফোরাম। এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর সম্মেলনকক্ষে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।

নিপীড়ন ও নির্যাতনের জন্য তথ্য গোপন রাখাকে একটি মোক্ষম কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়—মন্তব্য করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, তথ্য অধিকার নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে; কিন্তু তথ্য অধিকার ছাড়া সব অধিকার মূল্যহীন। তথ্য অধিকার না পেলে অন্য অধিকার প্রয়োগ করা যায় না।

আসিফ নজরুল বলেন, ‘কারা গুম করেছিল, এ ব্যাপারে কার দায়দায়িত্ব আছে, কারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করেছে, এটা যদি আমরা জানতে না পারি, তাহলে আমাদের জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করতে পারি না।’

আসিফ নজরুল বলেন, দেশে তথ্য অধিকারকে আন্দোলনে রূপান্তরিত করা যায়নি। অনেক এনজিও আছে। সবাই মিলে এটাকে আন্দোলনে পরিণত করতে পারেনি।

আসিফ নজরুল বলেন, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ যদি ঠিক না থাকে, তাহলে তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন কাজ করতে পারে না। তাই যাঁরা তথ্য অধিকারের কথা বলেন, তাঁদের যেকোনো আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলতে হবে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।

আইন উপদেষ্টা বলেন, গত সরকারের আমলে বিচার বিভাগকে নিপীড়নের হাতিয়ার, সংসদকে অন্যায় অবিচারের ফোরাম আর শাসন বিভাগকে নিপীড়ক যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছিল।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গত সরকারের আমলে তথ্য অধিকার আইন হয়েছিল। আবার তথ্য অধিকার বিনাশ করতেও অনেক আইন হয়েছিল। সাইবার সিকিউরিটি আইনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলার কারণে ডেইলি স্টার–এর সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৮০টির বেশি মামলা হয়েছিল। অথচ হত্যাকাণ্ডের একটি ঘটনায়ও দুটি মামলা করা যায় না।

সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হবে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, তথ্য অধিকারবিনাশী যেসব আইন করার চেষ্টা ছিল, বর্তমান সরকার সেগুলো বাতিল করবে। আর আইন কিছু সংশোধন করতে হবে।

তথ্য কমিশনের সংস্কার দাবি করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু তথ্য কমিশন নয়, সব কটি কমিশনকে আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি করা হয়েছে। এগুলো দলীয় প্রভাবে প্রভাবান্বিত ব্যক্তিদের অবসরের পর পুনর্বাসনকেন্দ্রের মতো হয়ে পড়েছে। যাঁদের সারা জীবন কাজ ছিল তথ্য চেপে রাখা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য গোপন রাখা, তাঁদের তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি তথ্য কমিশন সংস্কারের পাশাপাশি তথ্য অধিকার আইনেরও সংশোধন করার দাবি জানান।

‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তথ্য অধিকার: এনজিওদের সহায়ক ভূমিকা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় কথা বলেন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। আজ রোববার এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর সম্মেলনকক্ষে

গত সরকারের আমলে এনজিও ব্যুরোর কাজের সমালোচনা করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এক কর্তৃত্ববাদ থেকে আরেক কর্তৃত্ববাদে যাচ্ছে কি না, সেটি দেখতে হবে। শোনা যাচ্ছে, যারা আদিবাসীদের অধিকার, জেন্ডার ডাইভারসিটি নিয়ে কাজ করে, তাদের তহবিল ছাড় না করার নির্দেশনা দেওয়া হবে।

মতবিনিময় সভায় মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন তথ্য অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক শাহীন আনাম। তিনি তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে কিছু প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষগুলোর প্রস্তুতির অভাব আছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অনেকের দক্ষতার ঘাটতি থাকে। তথ্য কমিশনে রাজনীতিকীকরণ হয়েছে, এটার সংস্কার করতে হবে। অনেক এনজিওরও সমস্যা আছে, অনেকে তথ্য দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়নি।

নিজের উপস্থাপনায় তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের কিছু সফলতার কথাও তুলে ধরেন শাহীন আনাম। তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জনসচেতনতা বাড়ানো, দক্ষতা বৃদ্ধি, ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, তথ্য অধিকার–সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তিতে যত্নবান হওয়া, তথ্য অবমুক্তকরণ নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেন। শাহীন আনাম বলেন, তাঁরা চান নতুন পরিবেশে তথ্য চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে কোনো বাধা থাকবে না।

উন্মুক্ত আলোচনায় সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে তথ্য অধিকার আইন করা হয়েছিল; কিন্তু সেটি ব্যর্থ হয়েছে। তিনি নিজেই নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আবেদন করে তথ্য পাননি।

তথ্য অধিকার আইন সংস্কারের দাবি জানিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই আইনের আওতায় আনা উচিত কি না, তা নিয়ে আলোচনা দরকার।

এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মাহমুদুল হোসাইন খান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক আনোয়ার হোসেন, এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আইসোশ্যালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনন্য রায়হান।