ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ৪ নম্বর গেটের সামনে ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন ৩৪ বছর বয়সী এক নারী। পাশে পড়ে ছিল তাঁর ছয় বছর বয়সী মেয়ে। স্থানীয় এক ব্যক্তি দুজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেই রাতেই ওই নারীকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। খবর পেয়ে কোতোয়ালি থানা-পুলিশের এক কর্মকর্তা ঢাকা মেডিকেলে এসে ওই নারীর মরদেহের সুরতহাল করেন। চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, বিষক্রিয়ায় ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে।
কিন্তু নারীর পরিচয় জানত না পুলিশ। পরে তাঁর আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বের করে নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়। মারা যাওয়া নারীর নাম মাধুরী বিশ্বাস, বাড়ি বাগেরহাট। এরপর কোতোয়ালি থানা-পুলিশ ওই নারীর পরিবারের সদস্যদের ঘটনা জানায়। পরে মাধুরীর স্বামী পিংকু মজুমদার ঢাকায় এসে স্ত্রীর মরদেহ নিয়ে গ্রামে চলে যান। একই সঙ্গে মুমূর্ষু কন্যা শ্রেষ্ঠাকেও নিয়ে যান তিনি। মায়ের মৃত্যুর ৯ দিন পর ১৪ ডিসেম্বর মেয়েটি গোপালগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তারও মৃত্যু হয় বিষক্রিয়ায়।
কীভাবে মা-মেয়ের এই পরিণতি হলো, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারছিলেন না পরিবারের সদস্যরা। মাধুরীর স্বামী পিংকু মজুমদার পুলিশকে জানান, বাগেরহাটে চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে গত ২৮ নভেম্বর খুলনার তেরখাদা উপজেলার কামাররোল গ্রামে তাঁদের বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে বের হয়েছিলেন মাধুরী। রাতে তাঁদের বাসায় ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু মা ও মেয়ে ফিরে না আসায় মাধুরীর মুঠোফোনে ফোন দিয়ে তিনি বন্ধ পান। এরপর স্ত্রী-সন্তানের সন্ধান পেয়েছেন মাধুরীর মৃত্যুর খবরে।
এ ঘটনার তদন্তে পুলিশ মাধুরীর মুঠোফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) বিশ্লেষণ করে বিধান দাশ (২৪) নামের এক ব্যক্তির সন্ধান পায়। ঢাকার কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, মুঠোফোনে পটুয়াখালীর ছেলে বিধান দাশের সঙ্গে মাধুরীর পরিচয় হয়। এরপর তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে ওই দিন মেয়েকে নিয়ে বরিশালে চলে যান মাধুরী। একসঙ্গে কয়েক দিন কাটানোর পর ৪ ডিসেম্বর তাঁরা ঢাকায় আসার পর লঞ্চের মধ্যে মা ও মেয়েকে বিষ পান করিয়ে বিধান পালিয়ে যান।
এই হত্যাকাণ্ডে নিজের দায় স্বীকার করে বিধান দাশ ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। একই দিন বিধানের বিরুদ্ধে বিষপ্রয়োগে স্ত্রী ও মেয়েকে হত্যার অভিযোগে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন মাধুরীর স্বামী পিংকু মজুমদার।
বিধানের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলার দক্ষিণ দাশপাড়া গ্রামে। তিনি বাল্কহেডে বালু পরিবহনের কাজ করতেন এবং থাকতেন পটুয়াখালীতে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, বাল্কহেডের আরেক কর্মচারীর কাছ থেকে মাধুরীর মুঠোফোন নম্বর পান বিধান দাশ। মাস দুয়েক আগে ফোনে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ হয়। এরপর নিয়মিত তাঁরা মুঠোফোনে কথা বলতেন। বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলে মাধুরী খুলনা থেকে চলে আসেন বরিশালে। পরে বিধান, মাধুরী ও তাঁর মেয়ে বরিশালের একটি হোটেলে ওঠেন। ৪ ডিসেম্বর তাঁরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।
জিজ্ঞাসাবাদে বিধানের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত কর্মকর্তা ওসমান গনি বলেন, হোটেলে অবস্থান করার সময় মাধুরী বিধানকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। এতে ক্ষিপ্ত হন বিধান। এ জন্য হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। ৪ ডিসেম্বর লঞ্চে ওঠার আগে বরিশালের একটি দোকান থেকে কীটনাশক কেনেন। লঞ্চে মধ্যরাতে বিধান মাধুরী ও তাঁর মেয়ে শ্রেষ্ঠার মুখে বিষ ঢেলে দেন। এরপর অচেতন হয়ে পড়লে তাঁদের সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে রেখে পালিয়ে যান তিনি।
এ বিষয়ে বিধান দাশের পক্ষ থেকে আদালতের কাছে দাবি করা হয়েছে, তিনি নিরপরাধ।
স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যার দায়ে বিধানের কঠোর শাস্তি দাবি করেন মাধুরীর স্বামী পিংকু মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জানতেন না, তাঁর স্ত্রী বিধান দাশ নামের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতেন। কিন্তু বিধান দাশ তাঁর স্ত্রী-কন্যার জীবন শেষ করে দিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান পিংকু মজুমদার।