২০২৩ সালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ দশমিক ১ শতাংশে। ২০১৫ সালের পর এই হার সর্বনিম্ন।
দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে আট বছর আগের অবস্থায় চলে গেছে। ২০২৩ সালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ দশমিক ১ শতাংশে। ২০১৫ সালের পর এই হার সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জনসংখ্যাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে যাওয়ার পেছনে সরকারি সেবার মান ও মনোযোগ কমে যাওয়া যেমন দায়ী, তেমনি অসচেতনতা, দারিদ্র্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি নেওয়ার প্রবণতা কমেছে।
‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হারের সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস। গতকাল রোববার প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি নেওয়ার হার ৬১ শতাংশ এবং সনাতন পদ্ধতি নেওয়ার হার ১ শতাংশের বেশি। শহরের তুলনায় গ্রামে পদ্ধতি ব্যবহারের হার কম। এ হার শহরে প্রায় ৬৪ শতাংশ, গ্রামে প্রায় ৬২ শতাংশ।
‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হারের সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের জন্মনিরোধ সেবা ও সরবরাহ কর্মসূচি ইউনিটের সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সেবায় কোনো ঘাটতি নেই। প্রচার কার্যক্রমও চলছে। সরকার এখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার কথা বলে। মোট প্রজনন হার (টিএফআর) নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমানো হচ্ছে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য। টিএফআর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং মাতৃমৃত্যু কমেছে। ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী কিছুটা কমলেও উদ্বেগের কিছু নেই।
বিবিএসের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ ১০ বছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার ছিল ৬২ দশমিক ২ শতাংশ। এর পরের বছর ২০১৫ সালে এ হার সামান্য কমে দাঁড়ায় ৬২ দশমিক ১ শতাংশে। এরপর ২০২৩ সালের আগপর্যন্ত এ হার এর নিচে নামেনি।
বিবিএসের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে শুধু ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। তবে কী কারণে বা কোন অঞ্চলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার বেশি কমেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি নেওয়ার হার ৬১ শতাংশ এবং সনাতন পদ্ধতি নেওয়ার হার ১ শতাংশের বেশি। শহরের তুলনায় গ্রামে পদ্ধতি ব্যবহারের হার কম। এ হার শহরে প্রায় ৬৪ শতাংশ, গ্রামে প্রায় ৬২ শতাংশ।
জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমে সরকারের এখন কোনো মনোযোগ নেই। জনবলের কিছু ঘাটতি থাকলেও আর্থিক কোনো ঘাটতি নেই। অথচ মনোযোগের অভাবে এই কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রায়ই জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ঘাটতি দেখা যায়। গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে খাওয়ার বড়ি ও ইনজেকটেবল পদ্ধতির (ইনজেকশনের মাধ্যমে নেওয়া পদ্ধতি) সরবরাহ ছিল না। ভয়ের কারণ হচ্ছে, জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার কমলে গর্ভপাত ও গর্ভপাতের কারণে মৃত্যু বাড়ার আশঙ্কা থাকে। ২০১৬ সালে গর্ভপাতে মৃত্যু ৬ শতাংশ ছিল, যা এখন বেড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। আবু জামিল ফয়সালের মতে, জনসংখ্যা কার্যক্রম কেন মুখ থুবড়ে পড়েছে, তা ভালোভাবে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সারা দেশে সরকারিভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের সেবার মধ্যে রয়েছে খাওয়ার বড়ি, কনডম, দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি ইনজেকশন, ইন্ট্রা-ইউটেরিন ডিভাইস (আইডি) বা কপার টি ও ইমপ্ল্যান্ট, স্থায়ী পদ্ধতি এবং জরুরি বড়ি।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিবাহিত নারীদের মধ্যে জরুরি বড়ি ব্যবহারের হার ১ শতাংশের বেশি। অপরিকল্পিত যৌন মিলনের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সেবন করতে হয় জরুরি বড়ি।
জনসংখ্যাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে যাওয়ার পেছনে সরকারি সেবার মান ও মনোযোগ কমে যাওয়া যেমন দায়ী, তেমনি অসচেতনতা, দারিদ্র্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি নেওয়ার প্রবণতা কমেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নেওয়ার প্রবেশগম্যতা ও সরবরাহ—দুটি ক্ষেত্রেই সমস্যা রয়েছে। চর, হাওরসহ দুর্গম অঞ্চলে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সরকারি সেবার ঘাটতি রয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী এখন বেসরকারি খাতনির্ভর হয়ে পড়েছে। বেসরকারি খাতগুলো জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মূল্য বাড়িয়েছে। ফলে দরিদ্র ব্যক্তিরা অনেক সময় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী কিনতে না পেরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। তিনি বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ না করার সঙ্গে অল্প বয়সে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শঙ্কা বাড়ে। এতে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে।
বিবিএসের সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে পদ্ধতি গ্রহণকারী ব্যক্তিরা জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী কোথা থেকে বেশি পান, সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়নি। তবে সরকারের আরেক সংস্থা জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ৫৫ শতাংশ আধুনিক ও ৯ শতাংশ সনাতন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করে। আধুনিক পদ্ধতি নেওয়া ব্যক্তিদের ৬০ শতাংশের জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পাওয়ার উৎস হচ্ছে বেসরকারি খাত। অর্থাৎ বেসরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসক, ফার্মেসি, দোকান, বন্ধু বা অন্যান্য উৎস। এ হার ২০১১ সালে ছিল ৪২ শতাংশ, ২০১৭-২০১৮ সালে ৫০ শতাংশ।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমে সরকারের এখন কোনো মনোযোগ নেই। জনবলের কিছু ঘাটতি থাকলেও আর্থিক কোনো ঘাটতি নেই। অথচ মনোযোগের অভাবে এই কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে।আবু জামিল ফয়সাল, জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্যবিদ
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিচালক আবদুল লতিফ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ এখন আগের চেয়ে সচ্ছল। সরকারি সরবরাহের অপেক্ষা না করে হাতের কাছে যেখান থেকে কিনে নিতে সুবিধা, সেখান থেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী নেন। এ কারণে বেসরকারি খাত থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী কেনা বেড়েছে। তিনি বলেন, জনসংখ্যা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের নজর রয়েছে। নতুন জনসংখ্যা নীতির খসড়ার ওপর যাচাই–বাছাইয়ের কাজ চলছে।
বিবিএসের প্রতিবেদন অবশ্য বলছে, জন্মনিয়ন্ত্রণের অপূর্ণ চাহিদা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। অর্থাৎ যাঁরা জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে চান ও জন্মবিরতি চান, তাঁদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সরবরাহ কতটা পৌঁছায়, সে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২০২৩ সালে অপূর্ণ চাহিদার হার প্রায় ১৬ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ।
অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, পরিবার পরিকল্পনা একটি সামগ্রিক জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। সুস্থ জীবন পরিচালনা ও ভবিষ্যতের কর্মকাণ্ড নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা জরুরি। পরিবার পরিকল্পনার একটি অংশ হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে প্রবেশগম্যতা ও সরবরাহ বাড়াতে হবে। সরকারি সেবা গুণগত মানসম্পন্ন হতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের সংস্থাকে এ কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে এবং সামগ্রিক কাজে নজরদারি বাড়াতে হবে।