বাংলাদেশে বায়ুদূষণে জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব–সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ১৮ জানুয়ারি
বাংলাদেশে বায়ুদূষণে জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব–সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ১৮ জানুয়ারি

গবেষণার তথ্য

দেশে বায়ুদূষণে যারা মারা যায়, তাদের ৪৮% ঢাকা-চট্টগ্রাম নগরের

বায়ুদূষণ রোধ করা গেলে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জনের অকালমৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। বায়ুদূষণের কারণে যাদের মৃত্যু হয়, তাদের ৪৮ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরের মানুষ। ফিনল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে বায়ুদূষণে জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব–সংক্রান্ত এই গবেষণা প্রতিবেদন আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়। সিআরইএ ও সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক পলিউশন স্টাডিজ (ক্যাপস) যৌথভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।  ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে স্যাটেলাইটের তথ্য, আন্তর্জাতিক তথ্যভান্ডার ও সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য–উপাত্ত ব্যবহার করে এই গবেষণা করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ভার্চু৵য়ালি যুক্ত হয়ে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন এই গবেষক দলের অন্যতম সদস্য জেমি কেলি।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণ (অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫–এর উপস্থিতি) রোধ করা গেলে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জনের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এই দূষণ রোধ করা গেলে বছরে ৫ হাজার ২৫৪টি শিশুর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। এ ছাড়া হৃদ্‌রোগে ২৯ হাজার ৯২০ জন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ২৩ হাজার ৭৫ জন, সিওপিডিতে (দীর্ঘস্থায়ী অবরোধক ফুসফুসীয় ব্যাধি) ২০ হাজার ৯৭৬ জন, নিউমোনিয়ায় (নিম্ন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ) ৯ হাজার ৭২০ জন এবং ফুসফুসের ক্যানসারে ৩ হাজার ৬৩ জনের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।

গবেষণায় উঠে এসেছে, বায়ুদূষণজনিত অসুস্থতা হাঁপানির কারণে বছরে প্রায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার মানুষকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হয়। এই দূষণের কারণে বছরে ২৬ কোটি ৩০ লাখ কর্মদিবস নষ্ট হয়। বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৯ লাখ ৪৮৫টি শিশুর অকাল জন্ম হয়। ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩৮৯টি শিশু ওজনস্বল্পতায় ভোগে। বায়ুদূষণ না থাকলে বছরে মানুষের মৃত্যুহার ১৯ শতাংশ কমবে বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি। বায়ুদূষণের কারণে যাঁদের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরের। গ্রাম ও উপকূলীয় অঞ্চলে বায়ুদূষণ কম বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।

বায়ুদূষণের কারণও তুলে ধরা হয়েছে এই গবেষণায়। এতে প্রথম কারণ হিসেবে শিল্পকলকারখানার বায়ুদূষণকে তুলে ধরা হয়েছে। এরপর রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র, যানবাহনের দূষণ, নির্মাণকাজ ও বর্জ্যসহ বিভিন্ন জিনিস পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ। এ ছাড়া মৌসুমি ধুলাঝড় ও অন্য দেশ থেকে আসা দূষিত বায়ুও বাংলাদেশের বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়।

সিআরইএ–এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্লেষক ও এই গবেষণার প্রধান গবেষক ড্যানিয়েল নেসান বলেন, বায়ু মানের সামান্য উন্নতিও জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের স্বাস্থ্যসুবিধা দিতে পারে।

‘বায়ুদূষণে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার’

পরিবেশ বিগত সরকারের উন্নয়নের বলি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিগত সরকারের উন্নয়নতত্ত্বকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশ্ন করতে হবে।

শিল্প এলাকায় কারখানা না করে আবাসিক ও ফসলি এলাকায় করা হচ্ছে, এমন অসৎ ব্যবসায়ীরা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করছে বলে অভিযোগ করেন আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে পরিবেশদূষণের অভিযোগ আছে; কিন্তু এই সরকার এসে পরিবেশদূষণের জন্য একজন বড় ব্যবসায়ীকেও গ্রেপ্তার করেনি; বরং বড় ব্যবসায়ীদের জন্য ছবি তুলতে দেখা যাচ্ছে। দূষণকারীদের কাছ থেকে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের অনুদান নেওয়া হচ্ছে। এই বাস্তবতায় রাস্তায় পানি ছিটিয়ে বায়ুদূষণ কমানো যাবে না। ঢাকাকে আরও অবাসযোগ্য করতে বহুতল ভবনের অনুমোদন, যানবাহন বাড়ায় এমন প্রকল্প সরকার অনুমোদন দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি শুধু মানবদেহেরই ক্ষতি করছে না, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

ঢাকার বায়ুদূষণকে ‘রেড কনসার্ন’ উল্লেখ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, দূষণ রোধে মন্ত্রণালয় শেষ সামর্থ্যটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিনিয়ত নজরদারি করছে। নির্মাণ উপাদান রাস্তার ওপর রাখলে জরিমানা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে অবস্থিত সুইডিশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন) নায়োকা মার্টিনেজ–ব্যাকস্ট্রম বলেন, বায়ুদূষণ বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর অন্যতম গুরুতর সমস্যা। গণপরিবহন বায়ুদূষণ রোধে ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি গণপরিবহন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথাও জানান।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুল ইসলাম বলেন, বায়ুদূষণজনিত অসুখ নিয়ে অনেক রোগী পাচ্ছেন তিনি।

দূষিত বায়ুর কারণে বাচ্চাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয় উল্লেখ করে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক আয়েশা আক্তার বলেন, বায়ুদূষণের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে হাঁচি–কাশি হয়। তবে এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।

বায়ুদূষণ রোধে সরকারের যে নির্দেশনা, তা সরকারি ও বেসকারি নির্মাণকাজের সময় মানা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারি সৈয়দ মাহবুবুল আলম।