ইসরায়েলি কোম্পানির নজরদারির প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ

স্পিয়ারহেড নামের এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আশপাশের প্রায় আধা কিলোমিটারের মধ্যে থাকা এনক্রিপ্টেড হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা, ফেসবুক চ্যাট, যোগাযোগের তালিকা, কল ও টেক্সট মেসেজ সংগ্রহ করা যায়
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

ইসরায়েলের সাবেক এক গোয়েন্দা কমান্ডার পরিচালিত কোম্পানি থেকে নজরদারির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ সরকার। গত বছর বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি আনা হয়েছে বলে সরকারি নথি ও আন্তর্জাতিক রপ্তানি রেকর্ডের বরাত দিয়ে জানিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ।

আজ মঙ্গলবার পত্রিকাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ যে সরঞ্জাম কিনেছে, তা মুঠোফোন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগের ওপর নজরদারিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) কাছে এই প্রযুক্তি বিক্রি করেছে প্যাসিটোরা নামের একটি কোম্পানি। কোম্পানিটি সাইপ্রাসে নিবন্ধিত। তবে এটি পরিচালনা করেন ইসরায়েলের গোয়েন্দা প্রযুক্তি ইউনিটের সাবেক কমান্ডার টাল দিলিয়ান।

আগে কোম্পানিটির নাম ছিল উইস্পেয়ার। সে সময় মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দিলিয়ান তাঁর কোম্পানির নজরদারির প্রযুক্তি স্পিয়ারহেড সিস্টেমের কথা প্রকাশ করেছিলেন। এই সিস্টেমে রয়েছে নজরদারির সরঞ্জাম ও ট্র্যাকিং সফটওয়্যার দিয়ে সজ্জিত একটি ভ্যান। এটা সেলুলার ও ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মুঠোফোন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। আশপাশের প্রায় আধা কিলোমিটারের মধ্যে থাকা এনক্রিপ্টেড হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা, ফেসবুক চ্যাট, যোগাযোগের তালিকা, কল ও টেক্সট মেসেজ সংগ্রহ করতে পারে। উইস্পেয়ার নিয়ে একটি উপস্থাপনায় বলা হয়, এর মাধ্যমে আওতার মধ্যে থাকা কম্পিউটার ও ফোনে আড়ি পাতার জন্য স্পাইওয়্যারও প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যায়।

ফোর্বস-এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সাইপ্রাস সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। এ নিয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত হয়। শেষ পর্যন্ত দিলিয়ান ও তাঁর কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা অভিযোগ থেকে রেহাই পান। তবে অবৈধভাবে লারনাকা বিমানবন্দর দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের ডিভাইস থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য কোম্পানিটিকে ১০ লাখ ইউরো (প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা) জরিমানা করা হয়।

হারেৎজ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের জুন মাসে একটি স্পিয়ারহেড সিস্টেম সুইজারল্যান্ড থেকে ঢাকায় আনা হয়। প্রযুক্তি সরবরাহকারী ছিল প্যাসিটোরা। ক্রেতা এনটিএমসি। বাংলাদেশকে সরবরাহ করা চালানটির ওজন ৯৯১ কিলোগ্রাম। তাতে ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আড়ি পাতার ব্যবস্থা), অপারেটিং সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার (সার্ভার, ড্রাইভ, মনিটর ইত্যাদি) ছিল। এর জন্য মোট খরচ হয়েছিল ৫৭ লাখ ডলার (প্রায় ৬০ কোটি টাকা)।

প্যাসিটোরা হলো ইন্টেলেক্সা অ্যালায়েন্সের একটি প্রতিষ্ঠান। দিলিয়ান পরিচালিত কোম্পানিগুলোর একটি নেটওয়ার্ক এই ইন্টেলেক্সা। ইন্টেলেক্সার কাছে মোবাইল ফোন হ্যাকিং স্পাইওয়্যারসহ অত্যাধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি রয়েছে, যা তারা সারা বিশ্বের সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করে। নজরদারির এই প্রযুক্তি কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, তা শিখতে এনটিএমসির কমান্ডার ও অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ২০২১ ও ২০২২ সালে গ্রিস সফর করেছিলেন বলে হারেৎজ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এনটিএমসি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা। নজরদারির এই প্রযুক্তি কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ইসরায়েল থেকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সরাসরি কিছু কেনা হয়নি। এ বিষয়ে এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানও একই কথা বলেন।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি পাসপোর্টে ইসরায়েল ছাড়া বিশ্বের সব দেশের জন্য ‘বৈধ’ কথাটি লেখা ছিল। এখন সেটা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন বাংলাদেশের পাসপোর্ট সব দেশের জন্য বৈধ।

হারেৎজ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগে ২০২১ সালে ইসরায়েলি কোম্পানি সেলেব্রাইট বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) কাছে মোবাইল ফোন হ্যাকিং টুল বিক্রি করেছে। এ ছাড়া আল-জাজিরার প্রতিবেদনে উঠে আসে, আরেকটি ইসরায়েলি কোম্পানি পিকসিক্স বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে মোবাইল ফোনে নজরদারি ও হ্যাকিং সিস্টেম বিক্রি করেছে।