করোনা মহামারির সময় যখন জনজীবন চার দেয়ালে আবদ্ধ, হালিমা আফরোজ এবং তাঁর স্বামীরও মনে হয়েছিল শুধু ঘরে বসে থেকে লাভ নেই। কিছু একটা করা প্রয়োজন। শখের বশে বেকিং করে আত্মীয়স্বজনের বাসায় খাবার পাঠাতেন। কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন ব্যবসা শুরু করলেই হয়। হাতের মুঠোয় ইন্টারনেট তো আছেই। ব্যস, ফেসবুকে পেজ চালু করে ঘরে তৈরি খাবারের ফরমাশ নেওয়া শুরু হলো। হালিমার সেই প্রয়োজন ও শখের যাত্রা এখন পরিবারের মূল উপার্জনে পরিণত হয়েছে।
রাজধানীর বাসিন্দা হালিমা ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে অনলাইন ব্যবসা চালু করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শখের বশে শুরু হলেও ব্যবসার মাধ্যমেই আমার সংসার। এ ছাড়া আমার স্বামীও একটি দুর্ঘটনায় পড়ে। তখন দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিই, অনলাইন ব্যবসাটাকেই বড় করতে হবে। খাবারের পাশাপাশি অনলাইনভিত্তিক আরও একটি উদ্যোগ আছে আমাদের।’
তাহুরা বানুর গল্পটা একটু অন্য রকম। সাত বছর আগে প্রথম যখন তিনি নিজের শাড়ির ছবি ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন, ১৫ দিনেও কোনো সাড়া পাননি। এরপর নিজে শাড়িটি পরে পোস্ট করলে ভালো সাড়া পান। তাহুরার সেই অনলাইন ব্যবসা এখন অফলাইনেও আছে। বেড়েছে ব্যবসার পরিধি। তাহুরার মতো নারীদের আত্মনির্ভরশীল করার পথ দেখিয়েছে অনলাইন ব্যবসা। দেশে অনলাইন ব্যবসায়, বিশেষ করে গ্রামে নারীরাই এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
নওগাঁর তাহুরা বানুর সন্তানেরা একটু বড় হলে নিজেকে নিয়ে ভাবার সুযোগ পান। ফেসবুকে পেজ চালু করেন। একটু একটু করে নিজের ব্যবসা বড় করেছেন। নওগাঁয় একটি শোরুম দেওয়ার পর এখন ঢাকাতেও তিনি কারখানাসহ শোরুম চালু করার পরিকল্পনা করছেন। তাহুরা জানান, চাকরি করে পরিবারকে সময় দেওয়া কঠিন হতো। কিন্তু নিজেকেও আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। তাই অনলাইন ব্যবসায় আসা। নিজের সুবিধামতো এখানে সময় দেওয়া যায়।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের চলতি বছরের আগস্ট মাসে নারীদের ই-কমার্স ব্যবসাসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ই-কমার্স নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় প্রবেশকে সহজ করতে পারে। এর মাধ্যমে তারা অভিজ্ঞ হয়, বিশেষ আর্থিক যোগাযোগের ক্ষেত্রটা বড় হয়। পাশাপাশি ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক এবং বাজারের সুযোগও বাড়ে। ই-কমার্স প্রথাগত ব্যবসার চেয়ে সময়ের দিক থেকে অনেকটা সুবিধাজনক।
দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) হিসেবে, ই-কমার্স খাতে নারী উদ্যোক্তা ৯ শতাংশের মতো। ই-কমার্সের বাজারে নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ২৫ শতাংশ। তবে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায় নারীরা অনেক এগিয়ে। ই-ক্যাব জানিয়েছে, দেশে ৫ লাখ ফেসবুক পেজ আছে। নিয়মিত পণ্য বিক্রি হয়, এমন ফেসবুক পেজের ৫৫ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন।
ই-ক্যাবের মতে, ই-কমার্স খাতের বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো। যেখানে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বাজার নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে। অনলাইন ব্যবসায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও তাঁদের বেশির ভাগেরই ক্ষুদ্র উদ্যোগের ব্যবসা। তাই মার্কেট শেয়ার তাঁদের কম। নারী উদ্যোক্তারা সাধারণত ফ্যাশন, জীবনযাপনবিষয়ক সেবা ও পণ্য এবং খাবারভিত্তিক ব্যবসা বেশি করেন।
পারিবারিকভাবেই পোশাক খাতের ব্যবসা রয়েছে মুনিয়া জামানের। সেই ব্যবসা থেকেই প্রয়োজন বিবেচনা করে দেশীয় উপাদানে তৈরি ব্যাগের ব্র্যান্ড কালিন্দী শুরু করেন। যাত্রার তিন বছরে অনলাইনভিত্তিক এ ব্র্যান্ড ভালো অবস্থানে এসেছে। মুনিয়া জামান বলেন, ‘করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বেই ই-কমার্স ব্যবসার প্রসার ঘটে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেই অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায় আগ্রহী হয়।’ তিনি জানান, ‘অনলাইনে ক্রেতাদের ৭০ শতাংশ শহরভিত্তিক। নারী-উদ্যোক্তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও ক্রেতা এখনো শহরকেন্দ্রিকই বেশি।
নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি কোথাও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস) বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তাদের নারী মার্চেন্টের সংখ্যা প্রায় ৯ শতাংশ। তবে গ্রামে নারী মার্চেন্ট ১১ শতাংশ এবং শহরে তা সাড়ে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে ইন্টারনেটের প্রসারের কারণে নারীরা স্বল্প পুঁজি নিয়ে হলেও অনলাইন ব্যবসায় আগ্রহী হচ্ছেন। গ্রামের নারীরা সামাজিক বিধিনিষেধের মধ্যেও ঘরে বসেই আয়ের সুযোগ তৈরি করে নিচ্ছেন।
নারীরা আগ্রহী হলেও এখনো সমাজে লিঙ্গভিত্তিক ডিজিটাল বৈষম্য অনেক। মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ) চলতি বছরের মে মাসে ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৪’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পুরুষদের ৪০ শতাংশ এবং নারীদের ২৪ শতাংশ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কিন্তু ৫০ শতাংশ নারী ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে জানেন। কিন্তু পুরুষদের চেয়ে নারীরা ইন্টারনেট ব্যবহারে বেশি আগ্রহী।
আঙ্কটাডও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ডিজিটাল লিঙ্গবৈষম্য, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এবং সমাজে প্রচলিত ধারণা নারীদের ই-কমার্সে প্রবেশ এবং অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। বাধাগুলো দূর করতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ দেখা যায়। সম্প্রতি দেশের শীর্ষ মুঠোফোন অপারেটর গ্রামীণফোন গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট বিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে এবং দক্ষ করে তুলতে সারা দেশে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ নামে উঠান বৈঠক আয়োজন করেছে।
গ্রামীণফোনের এই প্রচারাভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারীদের মধ্যে ইন্টারনেট বিষয়ে শিক্ষা ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। যাতে গ্রামীণ নারীরা ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে জীবনের চলার পথে ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারেন।
দেশের অন্যতম নারী উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি। অনলাইনভিত্তিক চামড়ার ব্যাগ প্রস্তুতকারী ব্র্যান্ড গুটিপার স্বত্বাধিকারী তিনি। আট বছর আগে তিনি এ পথে হাঁটা শুরু করেন। তাঁর কাছে অনলাইনে নারীদের ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘অনলাইন ব্যবসায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী রয়েছেন। এ খাতের অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোক্তা অনেক। বিশেষ করে ক্ষুদ্র পরিসরের ব্যবসা। তাঁরা সামনে আসছেন না কারণ, গতানুগতিক ব্যবসা তাঁরা করেন না। পরিবার সামলে যে সময়টুকু পান, সেটুকুই তাঁরা ব্যবসায় দেন। অনেকের ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টও নেই। তাই সংখ্যার গণনায় তাঁরা আসছেন না। যে যাঁর মতো করে এখানে কাজ করে যাচ্ছেন।’
অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তাদের অনেকেই বলছেন, শহরকেন্দ্রিক ক্রেতা থাকলেও শহরের বাইরে থেকেও নানা ফরমাশ এখন আসে। অর্থাৎ ইন্টারনেটের প্রসার বাড়ছে, যার প্রভাব পড়েছে গ্রামাঞ্চলেও। আর ইন্টারনেট শেখার আয়োজনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের অনলাইনভিত্তিক ছোট ছোট উদ্যোগ নিতে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে, যা নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।