ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গতকাল মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে নাবিক সাজ্জাদ হোসেন তাঁর ভাবিকে ফোন করেন। ফোনের ওপাশ থেকে ভাঙা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমাদের জলদস্যুরা ঘিরে ফেলেছে। গোলাগুলিও করছে। দোয়া করিও।’
এ কথা বলেই ফোন কেটে দেন মো. সাজ্জাদ হোসেন (২৮)। এরপর পরিবারের সবার মনে দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। তাঁর মা সমশাদ বেগম (৫৫) ও বাবা মো. গাজু মিয়া (৬০) কান্নায় ভেঙে পড়েন। গতকাল থেকে তাঁদের দুজনের কান্না থামছে না। সাজ্জাদের ভাই মো. মোশাররফ মিয়া পরিবারের এমন করুণ পরিস্থিতির কথা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তিনি জানান, সাজ্জাদের দ্বিতীয় কল এসেছিল গতকাল বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। তাঁর মা ও বড় ভাই কথা বলেছেন।
সাজ্জাদ তাঁদের জানিয়েছেন, জলদস্যুরা স্পিডবোট নিয়ে জাহাজটির চারদিকে ঘিরে ফেলে। একদল জাহাজে উঠে পড়ে। সবার হাতে ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র। জাহাজের সবাই আতঙ্কিত।
গতকাল রাতে সমশাদ বেগমের সঙ্গেও কথা হয় প্রথম আলোর এ প্রতিবেদকের। আলাপকালে তিনি শুধুই কাঁদছিলেন। আর বলছিলেন, ‘ছেলের সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলতে পারলাম না। সে শুধু দোয়া করতে বলেছে।’
সাজ্জাদ হোসেনরা পাঁচভাই। বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার ১ নং বৈরাগ ইউনিয়ন পরিষদে। সাজ্জাদের বড় ভাই মোশাররফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল বিকেলের পর ভাইয়ের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে কাটছে। কী হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
মোশাররফ বলেন, ৭ বছর ধরে তাঁর ভাই জাহাজে চাকরি করছেন। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, তা কখনো ভাবেননি।
চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের মালিকানাধীন ২৩টি জাহাজের একটি এমভি আবদুল্লাহ। এর পণ্য পরিবহনক্ষমতা ৫৮ হাজার টন। জাহাজটি কবির গ্রুপের সহযোগী সংস্থা এসআর শিপিং লিমিটেডের। গতকাল মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টায় জাহাজটিতে উঠে নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জাহাজটিতে ৫৫ হাজার টন কয়লা রয়েছে। জাহাজে থাকা ২৩ নাবিকের সবাই বাংলাদেশি।
জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়া নিয়ে যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন (ইউকে এমটিও) তাদের ওয়েবসাইট ও এক্সে (সাবেক টুইটারে) বার্তা প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে এ ঘটনা ঘটেছে। দুটি নৌযানে (একটি বড় ও অপরটি ছোট) চড়ে জাহাজটির কাছাকাছি এসে জলদস্যুরা সেটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।
জলদস্যুরা জাহাজে উঠছেন, এমন একটি ভিডি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করেন আরেক নাবিক আসিফুর রহমান। গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় ওই ভিডিও তিনি পোস্ট করেছেন। এতে দেখা যায়, ছোট্ট একটি নৌযান থেকে রশি বেয়ে একজন জলদস্যু জাহাজটিতে উঠছেন।
নাবিক আসিফুর রহমানের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়। এ ঘটনার পর থেকে আসিফুরের মা নাসরিন আক্তার ও বাবা মো.আক্তার হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
আসিফুরের বাবা আক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল ইফতারের আগমুহূর্তে আসিফুর তাঁর মাকে ফোন করেন। সেই শেষ কথা। এরপর আর যোগাযোগ করা যায়নি।
আসিফুরের বোনের স্বামী সালাউদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আসিফুরের কাছে দুটি মোবাইল ছিল। জলদস্যুরা প্রথমেই একটা নিয়ে ফেলে। আরেকটি ফোন থেকে আসিফুর ফোন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইফতার করার জন্য জলদস্যুরা তাঁদের একটা কক্ষে নিয়ে গেছে। তবে কারও কোনো ক্ষতি করেনি।
সালাউদ্দিন জানান, আজ বুধবার বা আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে দুবাই পৌঁছানোর কথা ছিল আসিফুরদের। কিন্তু সেটি হলো না।