সরেজমিন

সংঘর্ষ–সংঘাতে গুরুতর আহতরা নানা ঝুঁকিতে

সংঘর্ষ–সংঘাতে আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৫৬ জন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে ৪০ জন।

মো. আরাফাত হোসেনের বাঁ পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলেছেন চিকিৎসকেরা। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) তাঁর চিকিৎসা চলছে ১৮ জুলাই থেকে। পা আর ফিরে পাবেন না।

৩০ বছর বয়সী মো. আরাফাত হোসেনের বাড়ি পাবনা শহরে। রাজধানীর উত্তরার একজন ব্যবসায়ীর গাড়িচালক তিনি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ–সহিংসতার শুরুর দিকে ১৮ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে উত্তরায় অন্য অনেকের মতো তিনিও পুলিশের গুলিতে আহত হন। তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে আনা হয়। দুদিন পর তাঁর পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে পঙ্গু হাসপাতালে কথা হয় মো. আরাফাত হোসেনের সঙ্গে। ম্লান মুখ। গলায় জোর নেই। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, কীভাবে বাকি জীবন চলবে, সেই চিন্তায় তিনি ঘুমাতে পারেন না। সুস্থ হয়ে তিনি ভবিষ্যতে গাড়ি চালাতে পারবেন বলে তাঁর মনে হয় না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপের পক্ষ থেকে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়ার কথা তাঁকে বলা হয়েছে।

পঙ্গু হাসপাতালের একই ওয়ার্ডে চারজনকে দেখা গেল, যাঁদের একটি করে পা কেটে ফেলেছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা প্রত্যেকেই আজীবনের জন্য প্রতিবন্ধিতার শিকার। তাঁরা প্রত্যেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ–সহিংসতার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

সংঘর্ষ–সহিংসতায় আহত ৫৬ জন গতকাল ওই হাসপাতালে ছিলেন। তাঁরা গত মাসের ১৮ থেকে এ মাসের ৫ তারিখের মধ্যে গুলিতে আহত হয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের শরীরে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে। কারও হাঁটুর নিচে, কারও পেটে বা ঊরুতে, কারও হাতে গুলি লেগেছে। তাঁদের প্রত্যেকের শরীরে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে বলে হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা প্রথম আলোকে বলেছেন।

অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত। কেউ হোটেলে কাজ করেন, কেউ গাড়ি বা রিকশা চালান, কেউ ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করেন। এসব রোগী বা তাঁদের সঙ্গে থাকা স্বজনেরা বারবার করে অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন। এই হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় বিনা মূল্যে হলেও কিছু খরচ রোগীপক্ষকে করতে হয়। সেই খরচও বহন করতে কেউ কেউ হিমশিম খাচ্ছেন।

রংপুরের বদরগঞ্জের মোহাম্মদ কাজল থাকেন শনির আখড়া এলাকায়। অটোরিকশা চালিয়ে জীবন চলে তাঁর। ১৯ জুলাই শনির আখড়া এলাকায় চলা সংঘর্ষে রাত নয়টার দিকে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। গুলিতে বাঁ ঊরুর হাড় ভেঙেছে। সেদিন থেকে তিনি হাসপাতালে। রক্ত, ওষুধ ও টুকটাক জিনিস কিনতে এ পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। চিকিৎসা এখনো শেষ হয়নি, সামনে আরও খরচ হবে। চিন্তায় তিনি, কীভাবে তা জোগাড় করবেন। অন্যদিকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও হয়তো আগের মতো শরীরে জোর পাবেন না।

১৩ নম্বর সাধারণ শয্যা থাকা ১৮ বছর বয়সী মো. রোমানের সমস্যা একটু আলাদা। ময়মনসিংহের ফুলপুরে বাড়ি তাঁর। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি বিরিয়ানির দোকানে কাজ করেন। ১৯ জুলাই রাত আটটার দিকে তাঁর পায়ে দুটি গুলি লাগে। একটি এফোঁড়–ওফোঁড় হয়ে রেবিয়ে গেছে। একটি গুলি এখনো পায়ে আটকে আছে।

উত্তরা স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী রাকিব উদ্দিন চিন্তিত তাঁর পরীক্ষা নিয়ে। এইচএসসি পরীক্ষা চলার মাঝে তিনি ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে পুলিশের গুলিতে তিনি আহত হন। গুলি পেছন দিক থেকে কোমর বরাবর ঢুকে সামনের দিক থেকে বেরিয়ে যায়। তিনি প্রায় প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন, শরীরের সমস্যাটা জটিল। তবে তাঁর চিন্তা চলমান পরীক্ষা নিয়ে। পরীক্ষা এখন স্থগিত আছে। আরও কিছু বিলম্বে শুরু হলে পরীক্ষায় বসা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করছেন।

পঙ্গু হাসপাতাল থেকে কিছু দূরেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সংঘর্ষ–সহিংসতায় আহত ৪০ জন রোগী এই হাসপাতাল দুটি ওয়ার্ডে গতকাল ভর্তি ছিলেন। তাঁদের একজন ইয়ামিন। তাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুর। তিন ভাই একসঙ্গে মোহাম্মদপুরে থাকেন। ইয়ামিন পিকআপ ট্রাকের হেলপার। বড় এক ভাই ট্রাকের চালকের সহকারী। অন্য ভাই ইলেকট্রিশিয়ান। ২০ জুলাই মোহাম্মদপুরে সংঘর্ষের সময় পেছন থেকে গুলি ঢুকে পেট ফুটো হয়ে বের হয়। সে কবে সুস্থ হবে, পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে কি না, হাসপাতাল ছাড়ার পর কোনো কাজ করতে পারবে কি না—সেই চিন্তা পেয়ে বসেছে ১৭ বছরের এই কিশোরের।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারা দেশে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। অনেকের আঘাত খুবই গুরুতর, কেউ কেউ চিকিৎসা করানোর খরচ মেটাতে পারছেন না। তাঁদের একটি অংশ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়বেন। অনেকের জীবিকা ঝুঁকিতে পড়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী না থাকলেও স্বাস্থ্যসচিব ও অন্য কর্মকর্তারা আছেন। তাঁদের একটি সভা করে এই ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে করণীয় ঠিক করতে হতো। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজের সুযোগ আছে। তারা দরিদ্র রোগীদের ওষুধ কিনে দিতে পারে। পুনর্বাসনেও সহায়তা করতে পারে।’