এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীরা এখন মূল বেতনের পুরোটা সরকার থেকে পান। এর সঙ্গে সামান্য কিছু ভাতা দেওয়া হয় তাঁদের। তবে বেসরকারি হওয়ায় তাঁরা সরাসরি রাজনীতি করার সুযোগ পান। এই সুযোগ বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করছেন জেলা প্রশাসকেরা (ডিসি)।
তাই সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্যও সুনির্দিষ্ট বিধিমালা করার প্রস্তাব এসেছে ডিসিদের পক্ষ থেকে।
২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন (ডিসি সম্মেলন)। সেখানে আলোচনার জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছেন ডিসিরা। এ ছাড়া উপজেলা শিক্ষা কমিটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) চেয়ারম্যান করাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সম্পর্কে এ রকম অন্তত ২৪৪টি প্রস্তাব এসেছে ডিসিদের পক্ষ থেকে। সম্মেলনে তিন দিনে ২৪টি অধিবেশনে এসব প্রস্তাবসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। তার ভিত্তিতেই নেওয়া হবে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এটাই শেষ ডিসি সম্মেলন। এই সম্মেলনে সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও সচিবেরা সরাসরি উপস্থিত থেকে ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন এবং বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে ডিসি সম্মেলন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর করবী হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেবেন ডিসিরা। সম্মেলন থেকে ডিসিদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। ডিসিরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুষ্ঠানের পরে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মন্ত্রণালয় ও বিভাগভিত্তিক কার্য অধিবেশন হবে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে (২৫ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সঙ্গে এবং তৃতীয় দিনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে ডিসিরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এতে উপস্থিত থাকবেন বিভাগীয় কমিশনারাও।
ডিসিরা মাঠপর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই ডিসি সম্মেলন ও ডিসিদের প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখে সরকার। সম্মেলনের আগে ডিসিরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বিভিন্ন প্রস্তাব পাঠান। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ডিসিদের কাছ থেকে আসা প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করে আলোচনার জন্য প্রস্তাব ঠিক করে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, এবার অন্তত ২৪৪টি প্রস্তাব এসেছে ডিসিদের পক্ষ থেকে।
সূত্র বলছে, এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য সরকারি কর্মচারীর মতো একটি বিধিমালা করার এই প্রস্তাব দিয়েছেন ঝিনাইদহের ডিসি মনিরা বেগম। প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে পাঠদান কার্যক্রমে তাঁদের দায়সারা আচরণ দেখা যায়। বিধিমালা হলে শিক্ষকতার পাশাপাশি ঠিকাদারি, সাংবাদিকতাসহ একাধিক পেশায় যুক্ত থাকার প্রবণতা ঠেকিয়ে শিক্ষকদের পাঠদানে আন্তরিক করা যাবে। বিধিমালা বা নীতিমালা থাকলে শিক্ষকতা পেশায় থেকে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করাও সম্ভব।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দেশের প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। বর্তমানে সারা দেশে শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীন ২০ হাজার ২৭৭টি এমপিওভুক্ত স্কুল ও কলেজ আছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৮ জন।
এ ছাড়া ২ হাজার ১৩৮টি এমপিওভুক্ত কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২০ হাজারের বেশি শিক্ষক সরকার থেকে মূল বেতন পান। আরও দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান নতুন করে এমপিওভুক্ত হয়েছে। তবে এখনো এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে মূল বেতন পাওয়া শুরু করেননি। এ ছাড়া সারা দেশে এমপিওভুক্ত ৮ হাজার ২২৮টি মাদ্রাসা আছে। এগুলোতে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা ১ লাখ ৬৪ হাজার।
বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধে ডিসিদের প্রস্তাবকে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের শামিল’ বলছেন বেসরকারি শিক্ষকনেতারা। স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব শাহজাহান আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ইউনেসকো ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইলএলও) সদস্য রাষ্ট্র। সে অনুযায়ী, শিক্ষকেরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে এবং দেশ গঠনে ভূমিকা নিতে পারবেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, সরকারকে আগে ইউনেসকো ও আইএলওর সদস্যপদ ছাড়তে হবে। তাই ডিসিরা যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটা অযৌক্তিক। এটা শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হনন করারই শামিল।
বেসরকারি শিক্ষকদের সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতা শাহজাহান আলম ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন তিনি। তবে পরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নির্দেশে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
বর্তমানে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কমিটিতে চেয়ারম্যান হন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানেরা। ইউএনওরা নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান। উপদেষ্টা হিসেবে শিক্ষা কমিটিতে থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। শরীয়তপুরের ডিসি মো. পারভেজ হাসান শিক্ষা কমিটিতে ইউএনওদের চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব দিয়েছেন। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছেন, ইউএনওরা চেয়ারম্যান হলে উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিদ্যালয় পরিদর্শন ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে বলেও তাঁর এই প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
তবে বর্তমানে অনেক উপজেলায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে ইউএনওদের একধরনের দূরত্ব আছে। এখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত হলে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব যেমন বাড়বে, তেমনি জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাও খর্ব হবে বলে মনে করেন অনেকেই।
বর্তমানে মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করে মাউশি। আগে মাদ্রাসাও এই অধিদপ্তরের অধীন ছিল। তবে এখন আলাদা অধিদপ্তর হয়েছে।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নামে স্বতন্ত্র একটি অধিদপ্তর করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব কার্যক্রম মাউশির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাই মাউশির কাজের চাপ বেশি থাকে। কাজের পরিমাণ বেশি হওয়ায় মাউশির সব কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমস্যা হয়। পৃথক অধিদপ্তর হলে সেবা প্রদান ও মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম পরিবীক্ষণ করা সহজ হবে।
অবশ্য জাতীয় শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিকের জন্য আলাদা অধিদপ্তর করার সিদ্ধান্ত থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। মাধ্যমিকের শিক্ষকেরাও এই দাবি করে আসছেন। বর্তমানে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাউশির মূল নেতৃত্বে আছেন। আলাদা বিভাগের বিষয়ে তাঁদের আপত্তি আছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তকে ট্রাফিক আইন বা সড়ক পরিবহন আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা, কক্সবাজারে বিশেষায়িত মেরিন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, শিক্ষার্থী কম এমন বিদ্যালয় বিলুপ্ত করে এর পাশের বিদ্যালয়ের সঙ্গে একত্রীকরণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে পোষ্য কোটা বাতিল, স্কুল ফিডিং প্রকল্প গ্রহণসহ প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সম্পর্কে আলাদা আলাদা প্রস্তাব দিয়েছেন ডিসিরা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিসি সম্মেলনকে সামনে রেখে ডিসিদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব আসে। প্রস্তাব আসার পর সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। অনেক প্রস্তাবের বিষয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হয়। আবার অনেক সিদ্ধান্ত মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। অনেক প্রস্তাব বাদও হয়ে যায়।