বর্তমানে মোট ছাত্রছাত্রী ৪০ হাজার ২২৬ জন। মোট আবাসিক হল ১৯টি। এর মধ্যে একটি বিদেশি শিক্ষার্থীদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়েন জান্নাতি ফাহমিদা। কিন্তু আবাসিক হলে সিট পাননি। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের এই ছাত্রী আজিমপুরের একটি মেসে (ছাত্রীনিবাস) থাকছেন। এ জন্য প্রতি মাসে তাঁকে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে।
ফাহমিদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাইরে থাকলে খাওয়ার সমস্যা, যাতায়াতের সমস্যা, পানির সমস্যা—মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ি। হল কর্তৃপক্ষকে অনেক বলেও সিট পাচ্ছি না।’
শুধু ফাহমিদাই নন। তাঁর মতো অনেক ছাত্রীকে আবাসিক হলে সিট না পেয়ে মেসে বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকতে হচ্ছে। এই ছাত্রীদের মতে, ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় তাঁরা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নিরাপত্তা নিয়েও থাকে নানা ধরনের শঙ্কা। তার ওপর অতিরিক্ত খরচ তো আছেই, যা তাঁদের শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মেয়েদের আবাসনের তীব্র সংকট থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নতুন হল নির্মাণের উদ্যোগ নিতে দেখি না। আবাসনসংকট কাটাতে একসঙ্গে একাধিক হল নির্মাণ জরুরি।আশরেফা খাতুন, শামসুন নাহার হলের শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১২ বছরের শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ছাত্রী ভর্তির হার দিন দিন বেড়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ দুই শিক্ষাবর্ষে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রী ভর্তির হার ছিল বেশি। কিন্তু সেই বিবেচনায় তাঁদের জন্য আবাসন সুবিধা বাড়েনি। ফলে বর্তমানে অধ্যয়নরত প্রায় ৫৭ শতাংশ ছাত্রী হলে সিট না পেয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সেই তুলনায় ছাত্রদের অবস্থা ভালো, তাঁদের ৩৪ শতাংশকে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে হচ্ছে।
এদিকে ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি হলে সিট সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ ছাত্রীকে আবাসন সুবিধা দেওয়ায় গাদাগাদি করে থাকছেন তাঁরা। পাঠাগার, রিডিং রুম, ডাইনিং-ক্যানটিন, রান্নাঘর, শৌচাগার—সবখানে চাপ থাকে সব সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এরই মধ্যে প্রথম বর্ষের নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভর্তি সম্পন্ন হলে ছাত্রীদের আবাসন–সংকট আরও তীব্র হবে।
আবাসন–সংকট সমাধানের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করছেন ছাত্রীরা। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার অবস্থান কর্মসূচি পালন ও উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেন ছাত্রীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রীদের আবাসন–সংকট কমাতে আপাতত বাঙ্ক বেড দিয়ে আসন বাড়ানো হয়েছে। যাদের আবাসিক সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে না, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তাঁদের আবাসন বৃত্তি চালু করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় দুটি আবাসিক হল নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে।
শিক্ষার্থী ভর্তির তুলনামূলক চিত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩ সালে ছাত্রী ভর্তির হার ছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ। সেখানে চলতি বছর সেটা ছিল ৫০ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছর ছাত্রী ভর্তির হার ছিল আরও বেশি, ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত ১২ বছরে যে হারে ছাত্রী ভর্তি বেড়েছে, সেই বিবেচনায় আবাসন বাড়ানো হয়নি। সর্বশেষ ২০১২ সালে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য কবি সুফিয়া কামাল হল উদ্বোধন করার পর আর কোনো হল নির্মাণ হয়নি। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ২০২০ সালে ৪৮ শতাংশ, ২০২২ সালে ৪৭ শতাংশ, ২০২১ সালে ৪৫ শতাংশ ছাত্রী ভর্তি হয়েছেন। ১২ বছরে ছাত্রী ভর্তির হার কখনো ৩৫ শতাংশের নিচে নামেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল আছে মোট ১৯টি। এর মধ্যে ছাত্রদের হল ১৩টি, ছাত্রীদের হল ৫টি এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ১টি হল। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী ৪০ হাজার ২২৬ জন। এর মধ্যে ২১ হাজার ৩৮০ ছাত্রের জন্য ১৩টি হলে সিট রয়েছে ১৩ হাজার ৪৯৪টি। বিপরীতে ১৮ হাজার ৮৪৬ ছাত্রীর জন্য ৫টি হলে সিট রয়েছে ৪ হাজার ৮৪৩। এই হিসাবে প্রতিটি সিটের বিপরীতে ছাত্রের সংখ্যা ১ দশমিক ৫৮। আর প্রতি শয্যার বিপরীতে ছাত্রীসংখ্যা প্রায় ৪ জন। হলের প্রতিটি শয্যায় সাধারণত দুজনের আবাসন ধরে হিসাব করে থাকে কর্তৃপক্ষ।
বাইরে থাকলে খাওয়ার সমস্যা, যাতায়াতের সমস্যা, পানির সমস্যা—মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ি। হল কর্তৃপক্ষকে অনেক বলেও সিট পাচ্ছি না।জান্নাতি ফাহমিদা
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে ছাত্রী হলগুলোতে থাকছেন ৮ হাজার ১০৭ জন ছাত্রী। আর ছাত্রদের হলগুলোতে থাকছেন ১৪ হাজার ৬৬ জন ছাত্র। দ্বৈত আবাসিকতাসহ নানা উদ্যোগে আবাসিকতা পেয়েছেন প্রায় ৪৩ শতাংশ ছাত্রী। আর ছাত্রদের মধ্যে আবাসিকতা পাওয়ার হার প্রায় ৬৬ শতাংশ।
ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত শামসুন নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ নাসরিন সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, সর্বশেষ হল নির্মাণের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ভর্তির হার কম ছিল। এখন সেটি বেড়ে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু আবাসিক হল বাড়েনি। ফলে বেড়েছে ছাত্রীদের আবাসন–সংকট।
ছাত্রীদের আবাসন–সংকট তীব্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের সবচেয়ে বড় আবাসিক হল বেগম রোকেয়া হল। হলটিতে ৫০১টি কক্ষে ২ হাজার ৪টি সিট রয়েছে। আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা ৭ হাজার ২৭৮ জন। এঁদের মধ্যে বর্তমানে আবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা ৩ হাজার ৫৬ জন।
এই হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থী নন্দিনী আহসান। তিনি পরিবারের সঙ্গে ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন। নন্দিনী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের “তরঙ্গ” বাসটি মোহাম্মদপুর পর্যন্ত যায়। সেখান থেকে আরও ৪০ মিনিটের পথ যেতে হয়। প্রতিদিন যাতায়াত ব্যয় আছে। এ ছাড়া বেশ সময় লাগে। অনেক সময়ই নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে উপস্থিত হতে পারি না। ক্লান্তও লাগে, মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ি।’
আবাসন–সংকটের কথা স্বীকার করেন এই হলের প্রাধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম। তিনি বলেন, ‘সবাই হলে থাকতে চায়। কিন্তু ঢাকার আশপাশে যাদের বাসা, গাজীপুর বা এ রকম দূর—তাদের বিবেচনায় নেওয়া হয় না।...যারা গ্রাম থেকে আসে, যাদের ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নেই, তাদের অগ্রাধিকার দিতে হয়।’
প্রাধ্যক্ষ হোসনে আরা বলেন, ৩৫টি কক্ষ ছাত্রলীগ নেত্রীদের দখলে ছিল। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেগুলো দখলমুক্ত করা হয়েছে। সেখানে প্রথম বর্ষের কিছু শিক্ষার্থীকে থাকার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে।
রোকেয়া হলের পর সবচেয়ে বেশি ছাত্রীর আবাসন সুবিধা রয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হলে। এই হলটিতে সিট রয়েছে ১ হাজার ৪০টি। আবাসিক ছাত্রী আছেন ১ হাজার ৮৮৩ জন। আর অনাবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা ২ হাজার ৮৮২ জন। হলের প্রাধ্যক্ষ সালমা নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের সংখ্যা বিবেচনায় আবাসন–সংকট প্রকট। এ অবস্থা দূর করতে নতুন ভবন নির্মাণের বিকল্প নেই।
প্রায় একই পরিস্থিতি অন্য তিন ছাত্রী হলেও। শামসুন নাহার হলে ৭০৯ জনের আবাসন সুবিধা রয়েছে। কিন্তু হলটিতে এই মুহূর্তে আছেন ১ হাজার ৪১৮ জন। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ৪৫০ সিটের বিপরীতে থাকছেন ৭৫০ ছাত্রী। হল প্রশাসন জানায়, আবাসিক ও অনাবাসিক মিলে হলটিতে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৬৪০টি সিটের বিপরীতে প্রায় ১ হাজার ছাত্রী থাকেন। এই হলের প্রাধ্যক্ষ আলেয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তবে আবাসন–সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য নতুন হল নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের “তরঙ্গ” বাসটি মোহাম্মদপুর পর্যন্ত যায়। সেখান থেকে আরও ৪০ মিনিটের পথ যেতে হয়। প্রতিদিন যাতায়াত ব্যয় আছে। এ ছাড়া বেশ সময় লাগে। অনেক সময়ই নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে উপস্থিত হতে পারি না। ক্লান্তও লাগে, মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ি।শিক্ষার্থী নন্দিনী আহসান
ছাত্রদের আবাসিক হলের পরিস্থিতি
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগের আমলে প্রায় সাড়ে ১৫ বছর হলগুলো নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল। হলে ‘গেস্টরুম’ কর্মসূচির নামে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটত প্রায় নিয়মিত। হলগুলোর অতিথি কক্ষে ‘আদবকায়দা’ শেখানোর নামে মানসিক নিপীড়নকে (কখনো কখনো শারীরিকও) বলা হতো ‘গেস্টরুম’। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা গেস্টরুম করাতেন। এ ছাড়া প্রতিটি হলে ‘গণরুম’ ছিল। ৮ জনের কক্ষে অন্তত ৩০ জন ছাত্রকে থাকতে হতো। গণরুমে থাকতে হলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্টের আগে ১৮টি হলে মোট গণরুম ছিল ১২৮টির মতো। ছাত্রদের ১৩টি হলে ৮৫টি গণরুমে প্রায় ১ হাজার ৮০০-এর বেশি ছাত্র থাকতেন। ছাত্রীদের ৫টি হলে ৪৩টি গণরুমে থাকতেন প্রায় ৬০০ ছাত্রী। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই পরিস্থিত নেই। গত সেপ্টেম্বরে ক্যাম্পাস খোলার পর হলগুলো এখন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। সেই গণরুমগুলো হল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য রুমগুলোর মতোই শিক্ষার্থীদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল সূত্র জানায়, আবাসিক ও দ্বৈতাবাসিকসহ হলটিতে শিক্ষার্থী থাকতে পারেন ৯৬৮ জন। হলটিতে এখন আবাসিক ছাত্র আছেন ৯০৫ জন। এই হলে প্রথম বর্ষেরই ১১৪ জন ছাত্র বৈধভাবে সিট পেয়েছেন। প্রথম বর্ষের যাঁরাই সিটের জন্য আবেদন করেছেন, সবাই সিট পেয়েছেন। জিয়া হলে এখন আর কোনো গণরুম নেই। ছেলেদের অন্যান্য হলগুলোর চিত্রও কাছাকাছি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসান একসময় গণরুমে থাকতেন। বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি বলেন, গেস্টরুম বন্ধ হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হলে থাকা সাবেক ছাত্ররা চলে গেছেন। এখন নিয়মিত বৈধ শিক্ষার্থীরা হলে সিট পাচ্ছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে হয় না বলে নিজেদের পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছেন। তাঁর মতে, অভ্যুত্থানের সুফল ভোগ করতে পারছেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের এ পরিস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। এমন আবাসন–সংকট থাকলে ছাত্রী ও অভিভাবকেরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে। মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় বিষয় হলো নিরাপত্তা। তা যদি না থাকে, তবে উচ্চশিক্ষায় মেয়েরা আসা কমিয়ে দেবে।সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী
হল নির্মাণের উদ্যোগ কম
বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ২০১৩ সালে ছাত্রদের জন্য ‘বিজয় একাত্তর’ হল উদ্বোধন হয়। আর ছাত্রীদের জন্য সর্বশেষ ২০১২ সালে কবি সুফিয়া কামাল হল উদ্বোধন করা হয়েছে। এরপর নতুন হল হয়নি। যদিও ছাত্রদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নতুন ভবন নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। এই হল হলে ছাত্রদের আবাসনের জন্য আরও এক হাজারটি সিট যুক্ত হচ্ছে। সিট বরাদ্দ হলে ছাত্রদের আবাসন–সংকট আরও কমে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০১১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আবাসনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১১টি ভবন নির্মাণ করেছে। এসব ভবনের ৬৬২ ফ্ল্যাটে ৬৬২ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারী থাকছেন।
প্রশাসনের উদ্যোগ ও আশ্বাস
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও প্রশাসন–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্রীদের হলগুলোতে আবাসন–সংকট কমাতে ‘বাঙ্ক বেড সিস্টেম’ (দোতলা শয্যা) চালু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত অক্টোবরে প্রথম ধাপে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের বিভিন্ন কক্ষে বাঙ্ক বেড স্থাপন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রীদের আবাসন–সংকট কমাতে আপাতত বাঙ্ক বেড দিয়ে আসন বাড়ানো হয়েছে। যাদের আবাসিক সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে না, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তাঁদের আবাসন বৃত্তি চালু করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় দুটি আবাসিক হল নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে।
তবে অস্থায়ী সমাধান নয়, আবাসন–সংকট সমাধানে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানালেন শামসুন নাহার হলের শিক্ষার্থী আশরেফা খাতুন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আশরেফা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েদের আবাসনের তীব্র সংকট থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নতুন হল নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখি না। আবাসন–সংকট কাটাতে একসঙ্গে একাধিক হল নির্মাণ জরুরি।’
শামসুন নাহার হল সূত্র জানায়, এই হলের নিচতলায় ৯টি বাঙ্ক বেডে ১৮ জন শিক্ষার্থী থাকেন। দ্বিতীয় তলার ১০টি বাঙ্ক বেডে ২০ জন এবং তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ১১টি বাঙ্ক বেডে ২২ জন ছাত্রী থাকেন। একটি সূত্র জানায়, শামসুন নাহার হলের মধ্য ভবনের পাঁচতলায় ৬০০ বর্গফুটের একটি কক্ষে আটটি বাঙ্ক বেডে থাকছেন ৩২ জন শিক্ষার্থী। অনেকেই এই কক্ষগুলোকে গণরুম বলছেন। এই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সুস্মিতা মুন্সি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তৃতীয় বর্ষে উঠেও এখনো “গণরুমে” থাকি। ছোট একটা কক্ষে ৮টি শয্যায় আমরা ১৬ জন থাকি। এটা যদি গণরুম না হয়, তাহলে এটা কী রুম?’
শামসুন নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ নাসরিন সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এটাকে গণরুম নয়, বলি বড় রুম। হলে একসময় বারান্দা ছিল, সেই বারান্দাকে রুম বানিয়ে এভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রশাসনিক ভবনের চতুর্থ তলার ‘রাজনৈতিক গণরুম’ বিলুপ্ত করে নাম রাখা হয়েছে ‘প্রতীক্ষা’। সেখানে প্রথম বর্ষের মেয়েদের পর্যাপ্ত বাঙ্ক বেড বসিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মাইশা মালিহা প্রথম আলোকে বলেন, হলগুলোতে আসন–সংকট থাকায় হয়তো ভালো করে থাকার সুযোগ হচ্ছে না। তবে এভাবে (গণরুমে) অন্তত কয়েকজন থাকতে পারছেন। আগের মতো গণরুমের ধারণা মাথায় নেই। নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের অধীনে তখন থাকতে হতো এবং তাদের কর্মসূচিতে যেতে হতো।
আবাসন–সংকটে অতিষ্ঠ নারী শিক্ষার্থীরা জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মানববন্ধন করেন। শতভাগ আবাসিকীকরণ ও প্রথম বর্ষ থেকে হলে আবাসিকতার দাবি জানান তাঁরা। এরপর গত ৩ অক্টোবর আবাসিক হলে শয্যার দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আবারও মানববন্ধন হয়। গতকালও একই দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন ও উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
ছাত্রীদের তীব্র আবাসন–সংকটের কথা স্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রীদের জন্য অন্তত দুটি হল নির্মাণ করা দরকার। ছাত্রীদের মানসম্পন্ন আবাসন সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না স্বীকার করে তিনি বলেন, ছাত্রীরা অন্তত যেন ক্যাম্পাসে থাকতে পারেন, সেই ভাবনা থেকে বাঙ্ক বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসন–সংকট মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় নিরুৎসাহিত করতে পারে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের এ পরিস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। এমন আবাসন–সংকট থাকলে ছাত্রী ও অভিভাবকেরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে। মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় বিষয় হলো নিরাপত্তা। তা যদি না থাকে, তবে উচ্চশিক্ষায় মেয়েরা আসা কমিয়ে দেবে।’ সমস্যার সমাধানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী বাজেটেই হল নির্মাণের বন্দোবস্ত রাখা ও হল নির্মাণ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে বাড়ি ভাড়া করে ছাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন, যেখানে ছাত্রীরাই বাসা ভাড়া দেবেন।