বরেণ্য শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ মঙ্গলবার। ‘আনিস স্যার’—এই ডাকেই তাঁর ছাত্র-অছাত্র সবার কাছেই প্রিয় ও পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি চিরবিদায় নিয়েছিলেন এক বড় দুঃসময়ে। মানুষ বলে থাকেন, ‘দুঃসময়ে সময় যেতেই চায় না, আর সুখের কালে সময় যায় বিদ্যুতের বেগে।’ সেই দুঃসময় পেরিয়ে এখন মনে হচ্ছে, চার বছর যেন চার পলকেই চলে গেল।
বিশ্বজুড়েই তখন কোভিড-১৯ মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে প্রবল পরাক্রম বিস্তার করেছিল। দ্রুত বদলে যাচ্ছিল পরিবেশ, পরিস্থিতি। যা কখনো কল্পনা করা যায়নি, দুঃস্বপ্নেও যা অবান্তর—তেমনই বাস্তবতা বিরাজ করছিল সর্বত্র। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল প্রতিদিন। মানুষ যেন পরিণত হয়েছিল নিছক সংখ্যায়। সামান্য সর্দি-জ্বর বলে লোকে যাকে সাধারণত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, সেই হাঁচি-কাশি যে মহাকাশ বিজয়ী আত্মগর্বী সভ্যতাকে এমন আমূল কাঁপিয়ে দেবে, কেই–বা তা আর ভেবেছিল!
এমন এক দুঃসহ পরিস্থিতিতেই আনিস স্যারের চিরবিদায়। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। কিছুদিন ধরে শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন, তবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন না কখনো। বিভিন্ন সমাবেশ, সেমিনার, কর্মশালা, উৎসবের উদ্বোধনী-সমাপনী আয়োজন আর সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি থাকতেন মধ্যমণি। অন্যায়ের বিরুদ্ধের প্রতিবাদ, ন্যায় ও যুক্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছিলেন অগ্রগামী। সত্য প্রকাশে সোচ্চার। কর্তব্য সম্পাদনে সাহসী। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে দ্বিধাহীন। আর বরাবরই ছিলেন উদ্যমী। ফলে সময়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি সক্রিয় থেকেছেন ঘরে-বাইরে।
এত বড়মাপের একজন মানুষ, এত মূল্যবান ছিল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সময়, তবু প্রয়োজনে পাওয়া যেত তাঁকে। অনেকে তাঁদের প্রয়োজনে, এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত প্রিয় আনিস স্যারকে পাশে পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে এ–ও ছিল তাঁর এক মহৎ মানবিক গুণ। সহজগম্য ছিলেন তিনি। লোকে স্বস্তির সঙ্গে তাঁর কাছে যেতে পারতেন। তিনিও সহজে গ্রহণ করতেন। অসংখ্য মানুষ এভাবেই তাঁর প্রীতিভাজন হয়েছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও তেমন একজন, ছাত্র হিসেবে শ্রেণিকক্ষে এবং পরে পেশাগত কারণে তাঁর নিবিড় সাহচর্য লাভে স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম। বিশেষ করে মনে পড়ছে, যেখানেই তিনি বক্তৃতা করেছেন, খুবই স্পষ্ট প্রাঞ্জল ভাষায়, অল্প কথায় মূল বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারতেন। সংবাদের শিরোনাম বা উদ্ধৃতির জন্য চমৎকার সব বাক্য থাকত তাঁর বক্তব্যে। ফলে প্রতিবেদন লেখা হতো বেশ সহজ, এ জন্য তিনি গণমাধ্যমকর্মীদেরও বিশেষ প্রিয় ছিলেন।
আনিস স্যারের বিদায়ের দিনটির কথা মনে পড়ছে। সেদিন ছিল শুক্রবার, পবিত্র জুমা। অথচ মসজিদ বন্ধ। কী দুর্বিষহ ছিল পরিবেশ! দোকানপাট, বড় বড় বিপণিবিতান, অফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে মানুষের কাছ থেকে। ‘বিধিনিষেধ’ (লকডাউন) বলে এক অচেনা শব্দ এক অদ্ভুত বাস্তবতা নিয়ে জুড়ে বসেছে চেতনার জগতে। কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে যে মহল্লায় কোনো কোভিড রোগীর সন্ধান পাওয়া যেত, ‘বিধিনিষেধ’ দিয়ে সেই এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
এভাবে রাজধানীজুড়েই চলছিল ‘বিধিনিষেধ’ পরিবেশ। কারফিউ বা তার চেয়েও অধিকতর নির্জন শূন্যতা নেমে এসেছিল রাজধানীর স্থবির বিষণ্ন দৃশ্যপটে। এমনই অবস্থায় সেদিন সকালে আমরা অপেক্ষা করছিলাম আজিমপুর কবরস্থানের প্রধান প্রবেশপথের পাশে।
স্যার ২০২০ সালের ১৪ মে বিকেলে ইন্তেকাল করেছিলেন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। মৃতদেহের পরীক্ষা করে জানানো হয়েছিল, তিনি শেষাবধি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন প্রধানত যোগাযোগ হচ্ছিল মুঠোফোনে। সেভাবেই জানা গিয়েছিল, পরদিন ১৫ মে সকালে আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে। প্রতিবেদনের কাজে আজিমপুর কবরস্থানে যাই। বেশ কড়া রোদ ছিল। তা সত্ত্বেও কোভিডকালের বিশেষ পোশাক ‘পিপিই’ পরতে হয়েছিল। মাথায় সার্জিক্যাল ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে পাতলা পলিথিনের দস্তানা। আগাগোড়া মোড়কে ঢাকা পুরো শরীর।
কবরস্থানের সামনের সড়কে একটি-দুটি দোকান হয়তো খোলা ছিল। খাঁ খাঁ করছিল চারপাশ। গণমাধ্যমের আরও কয়েকটি গাড়ি এসে থামল সেখানে। যত দূর মনে পড়ছে, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিলাম সবাই। পুলিশের একটি টহল ভ্যান এসেছিল। তারপর নিজের গাড়িতে এলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়ের। দূরত্ব বজায় রেখেই তিনি আমাদের জানিয়েছিলেন, একটু পরই স্যারের মরদেহ আসছে। ১০টার দিকে মরদেহবাহী গাড়িটি এল। ফটক দিয়ে ঢুকে থামল মসজিদের সামনে।
মহাকাশযাত্রীদের পোশাক যেমন দেখতে, প্রায় তেমনই সাদা পিপিই আবৃত কয়েকজন মানুষ নামলেন গাড়ি থেকে। আমরা বেশ খানিকটা দূর থেকে দেখছিলাম। তাঁরা খাটিয়া নামালেন গাড়ি থেকে। আবৃত ছিল জাতীয় পতাকায়। মসজিদের সামনেই দ্রুত তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছিল। জানাজা শেষে আগেই খোঁড়া পিতার কবরেই দাফন করা হয়েছিল তাঁকে।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান, অন্যদের মধ্যে বেঙ্গল গ্রুপের সভাপতি আবুল খায়ের, সরকারি কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশনের দুজন কর্মকর্তা, গার্ড অব অনারে অংশ নেওয়া পুলিশ ও আল-মারকাজুলের কয়েকজন কর্মীই কেবল তাঁর জানাজা ও অন্তিমযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন।
খুব দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত আয়োজনের মধ্য দিয়ে সবকিছু শেষ হয়েছিল। আমরা যার যার মতো ফিরে গেলাম। প্রথম আলোর কার্যালয়েও তখন ‘বিধিনিষেধ’। হোম অফিস চলছিল। বাসা থেকে প্রতিবেদন পাঠালাম। আনিস স্যারের চলে যাওয়ার শোক তো ছিলই। তবে তাঁর মতো একজন মানুষের এমন বিদায় খুবই অপ্রত্যাশিত ছিল। এ তো নিশ্চিত করেই বলা যায়—পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হতো তাঁকে। বাংলা একাডেমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও হয়তো আনা হতো।
জানাজায় অগণিত মানুষ অংশ নিয়ে সজল চোখে সশ্রদ্ধ বিদায় জানাতেন আনিস স্যারকে। ফুলে ফুলে ঢেকে যেত শবাধার। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম করেছিলেন তিনি, সেই সংগ্রামের স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হতে পারত তাঁর নাগরিক শোকসভা। কিন্তু হয়নি। এক নিদারুণ মহামারি কেবল তাঁকে কেড়েই নেয়নি, যথোচিত অন্তিম বিদায়ের আয়োজন থেকেও বঞ্চিত করেছে আমাদের। এই আক্ষেপ থাকবে। মৃত্যুদিবসে স্যারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, তাঁর আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তাঁর বাবা এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন সুখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিণী হলেও তাঁর লেখালেখির হাত ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামান ছিলেন পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। তিনি স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিতা জামান, শুচিতা জামান এবং ছেলে আনন্দ জামানকে রেখে গেছেন।
কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন আনিসুজ্জামান। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়েছেন। দেশভাগের পর তিনি খুলনা জিলা স্কুলে এবং তারপর ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (বর্তমানে নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়) পড়েন। ১৯৫১ সালে প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর লাভ করেন।
পরে আনিসুজ্জামান ‘ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’ শীর্ষক গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া ১৯৫৬ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ইয়ংবেঙ্গল ও সমকাল’ বিষয়ে পোস্টডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশাগত জীবন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে, ১৯৫৯ সালে। এরপর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। যুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন আনিসুজ্জামান। ১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি কমনওয়েলথ একাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন।
২০০৩ সালে অবসর নেওয়ার পর সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়। সব৴শেষ তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। যুক্ত ছিলেন সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’-এর সঙ্গে।
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দেশে-বিদেশ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ১৯৮৫ সালে ‘একুশে পদক’, ২০১৫ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ এবং ১৯৭০ সালে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়া তিনি দুবার আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দ পুরস্কার’, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডি-লিট’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী’ পদকসহ দেশ-বিদেশে অনেক পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘স্বরূপের সন্ধানে’, ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’, ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’, ‘কালনিরবধি’, ‘বিপুলা পৃথিবী’, ‘আমার একাত্তর’ ইত্যাদি।