প্রাণিসম্পদের ২৮ খামার

সরকারি মুরগির খামার কতটা কাজে আসছে

১৯ খামারের ৭০টি শেড অকেজো হয়ে গেছে। ১৭০টি শেড সচল আছে, তবে প্রায় সবই ভাঙাচোরা। অন্তত ২০টিতে জনবলসংকট রয়েছে।

রাজধানীর মিরপুরে সরকারি মুরগির খামার। সম্প্রতি তোলা
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার পাশে সরকারি কেন্দ্রীয় মুরগি খামার। খামারটিতে মুরগি ও বাচ্চা পালনের জন্য ৩৪টি ঘর বা শেডের মধ্যে ৭টিই অকেজো। সচল শেডগুলো বেহাল। কোথাও কোথাও পলেস্তারা উঠে গেছে। টিনের চালায় মরিচা পড়েছে। খসে পড়েছে বাঁশের চাটাই। খামারের ছয়টি ইনকিউবেটরের (বাচ্চা ফোটানোর যন্ত্র) চারটিই অকেজো।

১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কেন্দ্রীয় খামারসহ দেশে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মোট ২৮টি মুরগির খামার রয়েছে। বেশির ভাগেরই অবকাঠামোগত অবস্থা খারাপ, আছে জনবলসংকটও।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মুরগির খামারগুলো প্রতিষ্ঠার যে উদ্দেশ্যের কথা জানা যায়, তাতে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পালনের জন্য মুরগির বাচ্চা বিক্রি বা মাংসের জন্য ব্রয়লার ও ডিমের জন্য লেয়ার মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের বিষয়টি নেই। সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি অর্থে পরিচালিত খামারগুলো আসলে কতটা কাজে আসছে?

খামার আধুনিকায়ন করে বাণিজ্যিকভাবে মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে যাওয়া উচিত। এটা দেশের স্বার্থেই করা উচিত। তাহলে প্রান্তিক খামারিরা বাঁচবেন। সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
শেখ আজিজুর রহমান, সাবেক মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর

মিরপুর কেন্দ্রীয় খামারে গত ৬ জুলাই সরেজমিনে হতশ্রী চিত্র দেখা যায়। ২০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা এই খামারে একসময় প্রতি মাসে ১ লাখ ৯৬ হাজার মুরগির বাচ্চা ফোটানো হতো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অথচ গত জুনে সেখানে ফোটানো হয়েছে মাত্র ১৮ হাজার ৪২২টি বাচ্চা। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই খামারে এখন আর মাসে ৫০ হাজারের বেশি বাচ্চা ফোটানো সম্ভব নয়।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২৮টি মুরগির খামারের মধ্যে ৪টি খামারে সরেজমিনে ও ২১টি খামারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে খোঁজ নেওয়া হয়। এতে জানা যায়, ১৯টি খামারের ৭০টি শেড অকেজো হয়ে গেছে। ১৭০টি শেড সচল আছে, তবে প্রায় সবই ভাঙাচোরা, জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে ২৫টি খামারের মধ্যে অন্তত ২০টিতে জনবলসংকটের তথ্য পাওয়া গেছে।

মিরপুর কেন্দ্রীয় মুরগির খামারে গিয়ে দেখা যায়, দুই ধরনের মুরগির খামারের শেড (বাচ্চা ফোটানোর পর যেখানে রাখা হয় এবং মুরগি পালন করা হয়) রয়েছে। একটি শেডের ধরন আধা পাকা, আরেকটি পাকা। আধা পাকা শেডের মেঝে পাকা, দেয়াল লোহার জালের, যাতে বাতাস চলাচল করতে পারে এবং চাল টিনের। পাকা শেডের মেঝে ও ছাদ পাকা এবং দেয়াল লোহার জালের। এখানে ৩৪টি শেডের মধ্যে অবকাঠামোগত দুরবস্থার জন্য সাতটিই কোনো কাজে আসছে না। বাকিগুলোর অবস্থাও সুবিধার নয়। অথচ খামারগুলোর পেছনে প্রতিবছর অর্থ ব্যয় করছে সরকার।

সরকারের ব্যয়

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে ২৮টি মুরগির খামার বাদেও ২০টি হাঁসের খামার রয়েছে। মুরগি ও হাঁসের খামারের ব্যয়ের হিসাব একসঙ্গে করে থাকে অধিদপ্তর। এই হাঁস-মুরগির খামারে খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ, পানি, প্রভৃতি খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। এর বাইরেও প্রতিটি মুরগির খামারে ৩ থেকে ২০ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনেও সরকারকে বড় ধরনের অর্থ ব্যয় করতে হয়।

সরকার এসব খামার ভর্তুকি দিয়ে চালিয়ে গেলেও তা দেশের পোলট্রি খাতে ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সরকারি এসব মুরগির খামারে এক অর্থে দেশের অর্থের অপচয় হচ্ছে।

সরকারি মুরগির খামার কেন

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্রিটিশ সেনাদের মুরগি ও ডিমের চাহিদা মেটাতে ১৯৩৭ সালে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ উপজেলায় একটি মুরগির খামার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রথম মুরগির খামার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সেনাদের মুরগি ও ডিম সরবরাহের জন্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আরেকটি সরকারি খামার গড়ে তোলা হয়েছিল।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৭ সালে সিলেটেও আরেকটি সরকারি মুরগির খামার প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠে আরও পাঁচটি খামার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে ২০টি মুরগির খামার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর গত ৩০ বছর আর কোনো সরকারি মুরগি খামার গড়ে ওঠেনি।

এই খামারগুলোর স্বতন্ত্র ওয়েবসাইট নেই। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও এসব খামার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে সরকারি এই খামারগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী, তা আলাদা করে জানা যায় না। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মুরগির খামারগুলোর তিনটি উদ্দেশ্যের কথা বলছেন।

প্রথমত, ন্যায্যমূল্যে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের পারিবারিকভাবে পালনের জন্য মুরগির বাচ্চা দেওয়া, যাতে তাঁরা নিজেদের আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মুরগি বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হন। দ্বিতীয়ত, সরকারি খামার দেখে মানুষ যেন বাণিজ্যিকভাবে খামার গড়ে তুলতে উৎসাহী হন। তৃতীয়ত, মুরগির বিশুদ্ধজাত সংরক্ষণ করা।

এসব বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এমদাদুল হক তালুকদারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি তাঁর পক্ষে অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) এ বি এম খালেদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। খালেদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি মুরগির খামারগুলোর আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নে বড় একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এখন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠনের কাজ চলছে। প্রকল্প শেষে উন্নত প্রযুক্তিতে ব্রয়লারসহ সব জাতের বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব হবে। তবে এসব বাচ্চা পারিবারিক ছাড়া বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পালনের জন্য বিক্রি করা হবে না।

কাজে আসছে কতটুকু

সরকারি মুরগির খামারের উদ্দেশ্যগুলোর একটি মুরগির বিশুদ্ধ জাত সংরক্ষণ করা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খামারগুলোতে সোনালি, হোয়াইট রক, ফাওমি, আরআইআর, বিপিআর ও এলএস—এসব মুরগির জাত সংরক্ষণ করা হয়। অথচ দেশি যেসব মুরগি আছে, সেগুলোর বিশুদ্ধ জাত সংরক্ষণ করা হয় না।

যেমন গ্রামগঞ্জে বাড়িতে যে জাতের মুরগি পালন করা হয়, সেটির নাম ইন্ডিজেনাস নন-ডেসক্রেপটিভ ব্রিড (দেশীয় অবর্ণিত জাত)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায় আঁচিল নামে আরেক জাতের মুরগি পাওয়া যায়। আর পার্বত্য এলাকায় হিলি বার্ড নামে একটি জাত আছে। সরকারি খামারগুলো এসব মুরগির বিশুদ্ধ জাত সংরক্ষণ করে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সরকারি মুরগির খামারের আরেকটি উদ্দেশ্য, সেগুলো দেখে মানুষ যেন বাণিজ্যিকভাবে খামার গড়ে তুলতে পারেন। তবে সরকারি খামারগুলোয় বহু পুরোনো প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বেহাল হওয়ায় সেগুলো এখন আর মডেল খামার হিসেবে কাজ করে না। বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক খামারগুলো অনেক আধুনিক।

এ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে মুরগির বাচ্চার চাহিদা শতভাগ বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। এতে এই বাজারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। কয়েক মাস আগেও ব্রয়লারের বাচ্চার দাম নিয়ে তীব্র সংকটে ছিলেন প্রান্তিক খামারিরা।

এমনই একজন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার সোনারগাঁও গ্রামের তারিকুল ইসলাম। তিনি গত এপ্রিলে ৯২ টাকা করে এক দিনের ব্রয়লারের এক হাজার বাচ্চা কেনেন। ৩২ দিন পালনের পর সেগুলোর ওজন প্রায় দুই কেজি হলে ১৫০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি করেন। এরপরও তাঁর ক্ষতি হয় ৮০ হাজার টাকা।

বিপিএ সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, অল্প কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্রয়লারের বাচ্চা, খাবার ও খাবারের কাঁচামালের প্রায় শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। তারা বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে অনেক প্রান্তিক খামারি বাচ্চা তুলতে পারেন না। আবার তুললেও লোকসান দেন। এভাবে প্রান্তিক খামারে যখন মুরগি থাকে না বা কমে যায়, তখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মুরগি বাজারে বাড়তি দামে ছেড়ে দেয়। বাজার অস্থির হয়ে যায়। এখানে সরকারি খামারগুলোর ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, দেশে হাঁস-মুরগির যে চাহিদা, তার ৬০ ভাগ পূরণ হয় ব্রয়লার মুরগিতে। বেসরকারি হিসাবে ব্রয়লারের ভূমিকা আরও বেশি।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রয়লার মুরগির এক দিনের বাচ্চা প্রতিটি ৪৯-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য রঙিন জাতের এক দিনের বাচ্চা ১৬ থেকে ৭৪ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর সরকারি মুরগির খামারগুলো সব রঙিন জাতের এক দিনের বাচ্চা ১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

সরকারি খামারে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করা উচিত বলে মনে করেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক শেখ আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থেই করা উচিত। তাহলে প্রান্তিক খামারিরা বাঁচবেন। সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া এক দিনের মুরগির বাচ্চার বাজারও স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রথম আলোর চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ী প্রতিনিধি]