দেশের সংবিধানে শান্তিপূর্ণ সভা–সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত করা হলেও সরকারি দল দেশের বিরোধী দলকে সেই সুযোগ দিচ্ছে না। এ অবস্থায় রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারি দলের বিরোধ দেখা দিচ্ছে। বিরোধী দলকে ঠেকাতে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। গত ১৩ মাসে দেশে ৪৯৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭২ জন নিহত এবং ৭ হাজার ১২৪ জন আহত হয়েছেন।
আজ বুধবার সকালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে অনলাইনে মানবাধিকারকর্মীদের সংলাপের আয়োজন করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সেখানে আসকের উপস্থাপন করা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এই সংলাপে বিষয়টিকে ‘শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার অধিকার লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করেছে আসক।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আসক। নয়টি সংবাদপত্র, কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও আসকের সংগৃহীত তথ্য স্থান পেয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও কথিত বন্দুকযুদ্ধে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুমের শিকার হয়েছেন পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে চারজনকে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং একজন ফিরে এসেছেন। কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৮০ জন। তাঁদের মধ্যে কয়েদি ৩৪ জন ও হাজতি ৪৬ জন। সবচেয়ে বেশি ১৬ জন মারা গেছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। এ ছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৪ জন ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ১২ জন মারা গেছেন। এ সময় ২৩৪ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী। তিনি প্রতিবেদনের বিষয়ে বলার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদকে অনুরোধ জানান। তবে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কিছু বলেননি।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরাও এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করি। যে কেউ চাইলে আমাদের এখানে এসে অভিযোগও করতে পারেন। আমরা এসব অভিযোগ বিষয়ে অবহিত আছি। সমাধানে কাজ করে যাচ্ছি।’
আসকের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেছেন, গত এক বছরে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে সরকারি দল ও পুলিশ আক্রমণ চালিয়েছে। সমাবেশে যাতে সংগঠিত হতে না পারে, সেই চেষ্টাও করা হয়েছে। এমনকি বিরোধী দলের সমাবেশ অনুমোদনের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণও করা হয়েছে। এতে একধরনের উত্তেজনা তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দল ও মতকে দমন করার এই সহিংস তৎপরতা দুঃখজনক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
আরও যত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা
প্রতিবেদনে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়, মাঝে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমে গেলেও এখন আবার বাড়ছে। গত ১৩ মাসে অ্যাসিড–সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে ১৩টি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮৩ জন নারী। নির্যাতনের পর ৮১ জন নারী মারা গেছেন। এসব ঘটনায় ১৩১টি মামলা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭১ জন নারী। ধর্ষণের পর মারা গেছেন ৫০ জন। ধর্ষণের শিকার হয়ে আটজন নারী আত্মহত্যা করেছেন। আর ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৬৫ জন নারী।
এ ছাড়া পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫২০ জন নারী। এর মধ্যে ২২৪ জন নারীকে তাঁদের স্বামী হত্যা করেছেন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৩৮টি। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৭২ জন নারী। গৃহকর্মীদের প্রতি ৩১টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ফতোয়া ও সালিসের ঘটনা ঘটেছে ছয়টি।
১৩ মাসে ৫৫৮ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আসক বলছে, এই সময়ে ১ হাজার ১৪৩ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই সময় গণপিটুনিতে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সীমান্তে মৃত্যু কমছে না
আসকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তে মানুষের মৃত্যু কমছে না। এই ১৩ মাসে ১৮ জন বাংলাদেশি গুলিতে নিহত হয়েছেন। নির্যাতনের পর মারা গেছেন চারজন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১৯ জন।
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান দাবি করেন এ ধরনের হত্যা রোধে কমিশন সদা সক্রিয়। তিনি বলেন, সম্প্রতি সিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে সাতক্ষীরা এলাকার একটি সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সঙ্গে কমিশন কাজ করছে।
সংখ্যালুঘুদের প্রতি সহিংসতা
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৩টি। এতে ছয়টি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে ১১টি। মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে চারটি। তিনটি মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় পাঁচজন আহত হয়েছেন।
মানবাধিকার কমিশন দৃশ্যমান নয়
আজকের এ সংলাপে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানবাধিকারকর্মীরা অংশ নেন। তাঁদের আলোচনায় সীমান্ত হত্যা, পানি না পেয়ে কৃষকদের আত্মহত্যা, নির্মাণশ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা, বিদেশে নির্যাতনে নারী শ্রমিকদের মৃত্যু, সমতলের সংখ্যালঘুদের ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে হামলা-নির্যাতন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্মম নির্যাতনের অভিযোগসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে।
রাজশাহী থেকে রাশেদ রিপন নামের এক মানবাধিকারকর্মী বলেন, দেশের মানবাধিকার কমিশন দৃশ্যমান নয়। কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে সেখানে তারা যাবে, সমাধানের চেষ্টা করবে, যা তারা করছে না। মানবাধিকার কমিশনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয় হওয়া উচিত।
বৈশ্বিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন ‘বি’ গ্রেডের
জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, বিদ্যমান মানদণ্ড ও আসকের কার্যক্রম নিয়ে উপস্থাপনা করেন আসকের তামান্না হক। তিনি বলেন, জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত বৈশ্বিক জোটের সাবকমিটি অন অ্যাক্রিডিটেশন (এসসিএ) অনুযায়ী বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন ‘বি’ গ্রেড মর্যাদার। মানবাধিকার কমিশনের বিস্তৃত এখতিয়ার, বাছাই ও নিয়োগ, জনবল, প্রবেশগম্যতা ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও আর্থিক স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে এই গ্রেড দেওয়া হয়। তামান্না হক বলেন, বাংলাদেশের ‘বি’ গ্রেডের হওয়া দুঃখজনক।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা “বি” গ্রেড থেকে কীভাবে “এ” গ্রেডে উন্নীত হওয়া যায়, তার চেষ্টা করছি।’